মহররম : বিস্মৃত যেই ইতিহাস
- জাফর আহমাদ
- ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০
মহররম যুগ যুগান্তরের অনেকগুলো ঘটনার ভার বহন করে কালচক্রের পাখায় চড়ে বারবার আমাদের সামনে আসে। আরবি বর্ষ-পরিক্রমার এটি প্রথম মাস। এটি ‘আশহারুল হুরুম’ হারামকৃত মাস চারটির একটি। মহররম মানে সম্মানিত। নামের মাধ্যমেই সম্মানিত ও মর্যাদা পরিস্ফুট হয়েছে। ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল আলোচিত ঘটনাগুলো এ মাসেই সংঘটিত হয়েছে। এ মাসেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো ১০ মহররম, যা আশুরা নামে অধিক পরিচিত। ইতিহাসের নানা ঘটনায় ভরপুর এ দিনটি। এদিন আল্লাহ তায়ালা মূসা আ: ও তার কওমকে রা করেছেন এবং ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়কে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করিম সা: মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজী বললেন, এটি কী? তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাই মূসা আ: রোজা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, মূসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারি:১৮৬৫) ইমাম আহমাদ র: বর্ণনা করেছেন, ‘এটি সেই দিন যাতে নূহ আ:-এর কিস্তি জুদি পাহাড়ে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ আ: আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ রোজা রেখেছিলেন।’
আশুরায় দিনে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনাবলির মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো কারবালার মরুপ্রান্তরে ইয়াজিদ কর্তৃক ইমাম হোসাইন রা: ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ড। পৃথিবী তার বিশাল বুকে যতগুলো দুঃখ আর বেদনাকে ধারণ করে এখনো টিকে আছে এবং যতগুলো মর্মান্তিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ইতিহাসকে বারবার কাঁদায়, তারমধ্যে শাহাদতে কারবালা সর্বোচ্চ আসনকে সিক্ত করেছে। প্রতিটি মুসলমান পুরুষ ও নারী হজরত ইমাম হোসাইন রা:-এর শাহাদতের ঘটনায় আন্তরিক দুঃখ ও বেদনা প্রকাশ করে থাকে। নিঃসন্দেহে এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর প্রতি ঈমানের স্বাভাবিক প্রতিফলন এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এটি নিছক একটি হত্যাকাণ্ডই ছিল না, বরং এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাস তার সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ড যতটুকু বেদনাদায়ক তার চেয়েও বেদনাদায়ক হলো ইসলাম ও ইসলামী জীবনব্যবস্থা রাসূল সা: কর্তৃক প্রদর্শিত যেই রাস্তা বেয়ে পথ চলছিল, সেটি ইমামের হত্যার মাধ্যমে বাঁকা পথে মোড় নেয়। ইমাম আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাঁকা পথে আরোহণকারী ইসলাম নামক ট্রেনটির ড্রাইভার ট্রেনটিকে বাঁকা পথে নিয়ে যাচ্ছে। খুব সহসাই এর যাত্রীদের গোমরাহিতে নিমজ্জিত করবে। তাই তিনি পথভ্রষ্ট ড্রাইভারকে নামিয়ে ট্রেনটিকে সঠিক পথে তথা রাসূল সা: প্রদর্শিত পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাতিল রাষ্ট্রদণ্ডের মতাবলে তাকে এগোতে দেয়া হয়নি। বরং রাস্তার এ বিশাল বাধাকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য তাকে সপরিবারে শহীদ করে দেয়া হয়। ইমামের হত্যার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রকে অন্ধকার পথে নিয়ে যাওয়ার আর কোনো বাধাবিপত্তি রইল না।
ইমাম যে চেতনার কারণে তৎকালীন স্বৈরশাসক ও জালিমশাহীর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই চেতনা মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তোলার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের ইতিহাসের নি¤œলিখিত বিষয়গুলো জানতে হবে :
প্রথমত. উপলব্ধি করতে হবে, রাসূল সা: তাঁর অকান্ত পরিশ্রমে ইসলামের যে গাছটি পরিপূর্ণ মহিরূপে রেখে গেছেন, তার প্রথম থেকে শেষ অবদি চাুস সাী ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হজরত হোসাইন রা:। সেই আদর্শিক গাছটির ডালপালা কেটে দেয়া হয়। তখন তিনি এর প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আর এ জন্যই ইতিহাসের এ মর্মান্তিক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত. জানতে হবে, ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল কথা হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো পর্যায়ে পদ দাবি করার বা চেয়ে নেয়া যাবে না, আবার দায়িত্ব এলে তা শরয়ী ওজর ছাড়া অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
তৃতীয়ত. অবৈধভাবে নেতৃত্বের পালাবদলের কারণে তৎকালীন নেতৃত্ব জুলুমতন্ত্র কায়েম করে। ইসলামী রাষ্ট্রের সব স্তরে বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অশান্তি আর অস্থিরতা প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্বেষ, পেশিশক্তি, সঙ্কীর্ণ গোত্র বা বংশমর্যাদা এবং কুৎসিত ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষ দানা বেঁধে উঠে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ চরমভাবে অসহায়, মানবিক অধিকারবঞ্চিত দাসানুদাসে পরিণত হতে থাকে। রাজতান্ত্রিক শাসনের ফলে জনগণের ওপর মর্মস্পর্শী স্বৈরাচারী শাসন পরিচালিত হতে থাকে এবং আল্লাহর বিধিবিধান বিভিন্নভাবে অবহেলিত হতে থাকে। রাষ্ট্রের সহায়তায় মদ ও বারের আসর জমজমাট হতে থাকে। যেসব প্রতিষ্ঠানে আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, সেগুলো গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইয়াজিদ একটি স্বৈরাশাসকে পরিণত হয়ে চরম অহঙ্কারী ও সীমা লঙ্ঘনকারীতে নিমজ্জিত হয়। সে যা চিন্তা করে, তার যৌক্তিকতা সবাইকে মেনে নিতে বাধ্য করা হতে থাকে। তার কথাই হবে আইন, জনগণকে তা অকুণ্ঠ মনে ও নির্বাকচিত্তে মেনে নিতে হবে। কেউ তার স্বাধীন বিমুক্ত চিন্তা-বিবেচনা শক্তিও প্রয়োগ করতে পারছিল না। ফলে হজরত হোসাইন রা: শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে স্বৈরশাসকের গতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হন।
চতুর্থত. ইমাম হোসাইন রা: শাহাদাত আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। আমাদের ঈমামের শাহাদাতের মূল উদ্দেশ্য ভালো করে উপলব্ধি করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদি নীতি সংরণের জন্য ইমামের শাহাদাত ছিল এক ঐতিহাসিক নজরানা।
আমাদের প্রথমত ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই ইমামের প্রতি ভালোবাসার যথার্থতা প্রকাশ পাবে। মনে রাখতে হবে, এ পথে বাদ সাধবে পৃথিবীর তাবৎ তাগুতি শক্তি ও কায়েমি স্বার্থবাদীগোষ্ঠী। ইমাম হোসাইন রা:-এর মতো দৃঢ় ঈমান নিয়ে আমাদের এসব শক্তির মোকাবেলায় এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা