২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মহররমের শিা

-

প্রতি বছর নতুন হিজরি সনের বার্তা নিয়ে মহররম আমাদের মধ্যে আগমন করে। এটি আরবি বছর গণনায় প্রথম মাস। সৃষ্টির শুরু থেকে এ মাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বিধায় মহররম সম্মানিত ও মর্যাদাবান মাস। মহররম শব্দের অর্থ নিষিদ্ধ। এ মাসে কোনো প্রকার ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধবিগ্রহ করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ ছিল। সে কারণে মুসলিম মিল্লাতের কাছে এ মাস অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ।
মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরা নামে খ্যাত। আশুরা আরবি শব্দ। আশারাহ শব্দের অর্থ হলোÑ দশ। দশম দিবসে আশুরা পালিত হয় বলে একে আশুরা বলা হয়। দিবসটি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। এ মাসেই ঘটে গেছে অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই মহররমের শিা ও তাৎপর্য আলোচনা প্রসঙ্গে এসব ঘটনার কিছু অংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন। কেউ কেউ মনে করেন, এ দিনেই আল্লাহ তায়ালা দশজন নবীকে সম্মানিত করেছিলেন বলে একে আশুরা নামে অভিহিত করা হয়। এ দিনেই বিশ্বজাহান সৃষ্টি করা হয়, সব সৃষ্ট জীবের রূহ সৃষ্টি করা হয়, পৃথিবীর নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয় আশুরার দিনে। মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম আ:-কে এই দিবসেই সৃষ্টি করা হয়। এ দিবসেই আবার তাকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়। এ দিনেই আল্লাহ তায়ালা তার তওবা কবুল করেছেন, হজরত ইব্রাহিম আ:-এ দিবসেই জন্মগ্রহণ করেন এবং নমরুদের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে আশুরার তারিখে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
এ দিবসেই হজরত মূসা আ: ফেরাউনের বন্দিদশা থেকে তার কওমের লোকদের উদ্ধার করেছিলেন। হজরত ইউনুস আ: ৪০ দিন মাছের পেটে অবস্থান করে আশুরার দিন মুক্তি পান, হজরত ইউসুফ আ:-কে কুয়া থেকে উঠানো হয়েছিল, হজরত আইয়ুব আ: দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে এই দিন আরোগ্য লাভ করেছিলেন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন রা: ও তার পরিবার ও সঙ্গীরা কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন মহররমের ১০ তারিখে। এ রকম অনেক ঘটনার নীরব সাী হয়ে আছে মহররমের ১০ তারিখ। তবে আশুরা দুটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্য স্মরণীয়। তার একটি হলো ফেরাউনের নিপীড়ন থেকে হজরত মূসা আ:-এর মুক্তি লাভ। আর দ্বিতীয়টি হলো হজরত হোসাইন রা:-এর শাহাদাত। মুসলিম উম্মাহ এ দুটি ঘটনা অত্যন্ত সাড়ম্বরে স্মরণ করে থাকে।
কারবালার প্রান্তরে রাসূল সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রা:-এর শাহাদতের মর্মস্পর্শী ঘটনাটি মানবহৃদয়ে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। ঘটনাটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। ৬১ হিজরির মহররমের ১০ তারিখেই এই মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা হয়। ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে ইমাম হোসাইন রা: ও তার পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীরা শাহাদতবরণ করেন। ঘটনাটি ছিল বিষাদময়। তাই এটি বিশ্বমুসলিমের অন্তরকে আহত করে। চোখ অশ্র“ ভরাক্রান্ত হয়। তিনি জীবন দিয়েছেন তবুও বাতিলের কাছে নতি স্বীকার করেননি।
মানবতার এই দুর্দিনে আজ মহররম ও আশুরার এই অন্তর্নিহিত মর্ম ও তাৎপর্য অনুধাবনের প্রয়োজন। প্রয়োজন হজরত হোসাইন রা:-এর প্রকৃত অনুসারী। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত বীর সন্তানদের। অন্যায়, অসত্য, অনাচার আর পাপাচারের বিরুদ্ধে যাদের হোসাইনি শিরÑ যা করে সদা উন্নত। সত্য ও কল্যাণের স্বার্থে যে শির বিসর্জন দিতে তারা সামান্যতম দ্বিধা ও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আর তাদের এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে ইসলাম ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব ও মর্যাদা, হারানো শান-শওকত ও প্রভাব-প্রতিপত্তি। যুগে যুগে সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডাবাহী এসব বীর সন্তানদের আত্মবিসর্জনের মাধ্যমেই ইসলাম নবজীবন লাভ করেছে। তাই তো কবি বলেছেন, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালাকে বাদ।’
নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও মতালোভী ইয়াজিদ মারা গেছে। কিন্তু তার উত্তরসূরিরা আজো বেঁচে আছে। অন্যায়, অসত্য, অনাচার, পাপাচার, স্বৈরাচারে তারা বিষাক্ত করে চলেছে মানবসমাজকে। পৃথিবীর আনাচেকানাচে তারা জন্ম দিয়ে চলেছে নিত্যনতুন কারবালার বিষাদময় কাহিনী। তাদেরকে আজ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করা প্রয়োজন।
মর্সিয়া ও তাজিয়া, আলোচনা ও আনুষ্ঠানিকতায়ই যেন এই মহান আশুরা আবিষ্ট না হয়ে পড়ে। কারণ, কুরআন ও হাদিসের আলোকে এ রকম করার কোনো বিধানও নেই। শরিয়তও এসব পদ্ধতি পছন্দ করে না বিধায় সব ধরনের বিদআত ও কুপ্রথা মাতম-মর্সিয়া বর্জন করে মহররম ও আশুরার প্রকৃত শিা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে। ইসলামকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে সব ধরনের অন্যায়কে পিছনে ফেলে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের শিা গ্রহণ করতে হবে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ইমাম হোসাইনের সে দিনে দৃঢ়প্রত্যয় ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের দীা গোটা মুসলিম জাতিকে আরো ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাবি


আরো সংবাদ



premium cement