২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জালিমের শাস্তি

-

জুলুম আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ অত্যাচার করা, অবিচার করা, কাউকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা বা অন্যায়ভাবে কাউকে শারীরিক-মানসিক-আর্থিক কষ্ট দেয়া। জুলুম একটি জঘন্যতম অপরাধ। এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। সব ধর্ম মতেই জুুলুম মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য। কুরআন-সুন্নাহ জুলুম এবং জালিমের শাস্তির ব্যাপারে কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছে। কঠোর ভাষায় জুলুমকে নিষেধ করেছে।
আল্লাহ বলেন : ‘তুমি কখনো মনে করো না যে, জালিমেরা যা করে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আল্লাহ গাফিল, তবে তিনি সে দিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন তাদের চু হবে স্থির। ভীতবিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছোটাছুটি করবে, নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (আশা) শূন্য। যেদিন তাদের শাস্তি আসবে, সেদিন সম্পর্কে তুমি মানুষকে সতর্ক করো, তখন জালিমরা বলবেÑ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে কিছু কালের জন্য অবকাশ দিন, আমরা আপনার আহ্বানে সাড়া দেবো এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। (আল্লাহ বলবেন) তোমরা কি আগে শপথ করে বলতে না যে, তোমাদের কখনো পতন হবে না? অথচ তোমরা বাস করতে তাদের বাসভূমিতে যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল এবং তাদের প্রতি আমি কি করেছিলাম (অর্থাৎ কী কঠিন শাস্তি দিয়েছিলাম) তা তোমাদের কাছে ছিল সুস্পষ্ট এবং আমি তোমাদের কাছে তাদের (শাস্তির) দৃষ্টান্তও উপস্থিত করে ছিলাম। তারা ভীষণ চক্রান্ত করেছিল। কিন্তু আল্লাহর কাছে রয়েছে তাদের চক্রান্তের শাস্তি। তাদের চক্রান্ত এমন ছিল না যে, পাহাড় টলে যায়। অথবা তাদের চক্রান্ত ছিল পাহাড় টলে দেয়ার মতো কঠিন। (এসব সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের সব ষড়যন্ত্রকে ও চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়ে তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করেছেন) তুমি কখনো মনে করো না যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলদের প্রতি প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করেন। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।’ (অতএব জালিমকে আল্লাহ অবশ্যই কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন, দুনিয়ার কোনো শক্তিই তা ফেরাতে সম হবে না) (সূরা ইব্রাহীম, ৪২-৪৭) আল্লাহ বলেনÑ ‘আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে, তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল বিদগ্ধ করবে, এটি কত নিকৃষ্ট পানীয়, জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়।’ (সূরা কাহফ; ২৯) আল্লাহ বলেন; তাদের সতর্ক করে দাও আসন্ন দিন (কেয়ামত) সম্পর্কে এবং দুঃখকষ্টে তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। জালিমদের জন্য কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই এবং যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে এমন কোনো সুপারিশকারীও নেই। (সূরা মুমিন, ১৮) এভাবে কুরআনুল কারিমের অনেক আয়াত রয়েছে,যাতে জালিমের কঠিন শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ জালিমকে সুযোগ দেন, ছাড় দেন না। জালিমকে তার জুলুমের শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে, মাজলুমের কাছে মা চেয়ে মাফ করানো ছাড়া এ শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
এভাবে অনেক হাদিস রয়েছে, যাতে জালিমের কঠিন শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে, যেমনÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছেন : ‘জুলুম করা থেকে বেঁচে থাক; কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন বহু অন্ধকারের কারণ হবে।’ (বুখারি, মুসলিম) জালিম জুলুমের কারণে কিয়ামতের দিন বিভিন্ন ধরনের অন্ধকারে পতিত হবে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রতি জুলুম করেছে, তার সম্মান বা অন্য কোনো বিষয়ে, তবে সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, ওই দিনের আগে যে দিন তার কাছে দিনার-দিরহাম কিছুই থাকবে না (মৃত্যু বা কিয়ামত দিবসের আগে)। যদি তার কাছে নেক আমল থাকে, তবে তার জুলুম পরিমাণ নেকি নেয়া হবে, আর যদি তার কাছে নেকি না থাকে, তাহলে মাজলুম ব্যক্তির গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারি) আবু মূসা রা: বলেনÑ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারীকে (এক নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত) অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাকে পাকড়াও করেন, তখন আর তাকে ছাড়েন না। অতঃপর তিনি আয়াতটি পাঠ করলেন, ‘আর এ রূপেই তখন তিনি কোনো জনপদের অধিবাসীদেরও পাকড়াও করেন, যখন তারা অত্যাচার করে। নিঃসন্দেহে তাঁর পাকড়াও হচ্ছে অত্যন্ত যাতনাদায়ক ও কঠিন (সূরা হুদ; ১০২)। আলী রা: বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; ‘তুমি মাজলুমের বদদোয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো, কেননা সে আল্লাহর দরবারে নিজের হক প্রার্থনা করে। অথচ আল্লাহ তায়ালা কোনো হকদারকে তার হক হতে বঞ্চিত করেন না।’ (বায়হাকি) আওস বিন শুরাহবিল রা: থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো জালিমের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য তার সাথে চলে; অথচ সে জানে যে, সে জালিম তাহলে সে ইসলাম হতে বের হয়ে গেল।’ (বায়হাকি) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন; ‘মাজলুমের বদদোয়া থেকে বাঁচো, কেননা মাজলুমের বদদোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।’ (বুখারি) অর্থাৎ মাজলুমের দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়।
জালিম যতই শক্তিশালী হোক না কেন, যতই মতাধর হোক না কেন, আল্লাহর শাস্তি হতে কখনো সে রেহাই পাবে না। আল্লাহর শাস্তি বিলম্ব হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর শাস্তি যখন আসবে, দুনিয়ার এমন কোনো শক্তি নেই, তা ঠেকাতে পারে। আল্লাহ সুযোগ দেন, ছাড় দেন না। আল্লাহ বলেন : ‘আমি তাদেরকে অবকাশ দিয়ে রাখি। আমার কৌশল অতি শক্তিশালী।’ (সূরা নুন, ৪৫) ‘যারা আমার আয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, আমি তাদের অজ্ঞাতে তাদেরকে ধীরে ধীরে পাকড়াও করব। আমি তাদের অবকাশ দিচ্ছি, নিশ্চয় আমার কৌশল অতি শক্ত।’ (সূরা আরাফ; ১৮২, ১৮৩) ‘আল্লাহ তাদের নিজেদের অবাধ্যতার মধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ফেরার জন্য ঢিল দেন।’ (সূরা বাকারাহ ১৫) আল্লাহ অতীতে কাউকে ছাড় দেননি, যতই তার শিকড় শক্ত হোক। ফেরাউন তার শক্তির দাম্ভিকতায় নিজেকে রব বলে দাবি করেছে। স্বীয় মতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য এবং এ পথের কাঁটাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য সে দেশের সব নবজাতক পুত্রসন্তানদের জবেহ করেছে। কিন্তু মহান আল্লাহ যা করার তা করবেনই, দুনিয়ার কারো কোনো শক্তি নেই তা রোধ করার। আল্লাহ বলেনÑ নিশ্চয় তোমার রব যা চান, তা তিনি করবেনই। (সূরা হুদ, ১০৭) ‘যা তিনি চান, তা তিনি করবেনই’ (সূরা বুরুজ, ১৬) ‘নিশ্চয়ই তোমার রবের পাকড়াও বড়ই কঠিন’। (সূরা বুরুজ, ১২)’ আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে জালিমদের কঠিন শাস্তি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছেন। নিকটাতীতেও দেখা যায়, জালিম শাসকেরা কিভাবে লাঞ্ছনা নিয়ে মতাচ্যুত হয়ে অপমানের গ্লানি নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছে। ইরানের পাহলভি ও ফিলিপাইনের মার্কোস তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর একটি কথাও জেনে রাখা প্রয়োজন, মহান আল্লাহর সাথে তাঁর ইবাদতে, মতায়, আইন রচনায় প্রভৃতিতে অন্য কাউকে শরিক করা হলো সবচেয়ে বড় জুলুম। আল্লাহ বলেন; ‘নিশ্চয় শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম’ (সূরা লোকমান, ১৩) এমনিভাবে আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করা, আল্লাহর দীনকে অমান্য করা, নবী-রাসূলদের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করাও জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ এ কারণে অতীতের অনেক জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেনÑ ‘এবং আমি নিদর্শন রেখেছি মূসা আ: এর ঘটনায়, যখন আমি তাকে স্পষ্ট প্রমাণসহ ফেরাউনের কাছে পাঠালাম, তখন সে মতার দম্ভে মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং বলল, এ একটা জাদুকর বা উন্মাদ। সুতরাং আমি তাকে ও তার সেনাবাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং তাদের সমুদ্রে নিপে করলাম এবং সে তিরস্কৃত হলো। এবং নিদর্শন রয়েছে ‘আদের ঘটনায়, যখন আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম অকল্যাণকর বায়ু, এটি যা কিছুর ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল, তাকেই জরাজীর্ণ করে দিয়েছিল। আরো নিদর্শন রয়েছে সামুদের কাহিনীতে, যখন তাদেরকে বলা হলো, তোমরা ভোগ করে নাও কিছুকাল। তারা তাদের প্রতিপালকের কথা অমান্য করল, ফলে তাদের প্রতি বজ্রাঘাত হলো এবং তারা দেখছিল। তারা উঠে দাঁড়াতে পারল না এবং তা প্রতিরোধও করতে পারল না। আর (ধ্বংস করেছিলাম) ইতঃপূর্বে নুহের আ: সম্প্রদায়কে, তারা ছিল ফাসেক সম্প্রদায়।’ (সূরা জারিয়াত, ৩৮-৪৬) এভাবে ধ্বংস করেছেন লুত আ:, সামুদ আ: সম্প্রদায়সহ আরো অনেক সম্প্রদায়কে, যারা আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতকে অস্বীকার করেছিল। যাদের ধ্বংসাবশেষ অদ্যাবধি রয়েছে। আল্লাহ বলেন; ‘ বলো (হে মুহাম্মদ) তোমরা ভূপৃষ্ঠে পরিভ্রমণ করো, অতঃপর মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের পরিণাম কি হয়েছে, তা গভীর অভিনিবেশসহকারে ল করো। (সূরা আনয়াম, ১১)’ বলো! পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখ, অপরাধীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছে।’ (সূরা নামল; ৬৯)
আজ পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন অঞ্চলে যারা জুলুম করে যাচ্ছে, অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাচ্ছে, তাদের উচিত অতীত ইতিহাস থেকে শিা নেয়া, কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে জুলুম অত্যাচারের পথকে পরিহার করা। এতে তারাও শান্তি পাবে এবং জাতিও মুক্তি পাবে। মনে রাখা দরকার, মতা-দম্ভ, অর্থ ও শক্তি এক দিন শেষ হবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ


আরো সংবাদ



premium cement