২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ফজিলতময় ইবাদত হজ

-

আরবি ‘হজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা বা সঙ্কল্পবদ্ধ হওয়া। তবে ইসলামী বিধানে হজ বলতে বোঝায়, মুসলিম উম্মাহ নির্ধারিত সময়ে এবং নির্ধারিত নিয়মে পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থিত বায়তুল্লাহ তাওয়াফ এবং মক্কার নিকটবর্তী মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা প্রভৃতি স্থানে গমন, অবস্থান এবং সেখানে নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদন করা। বিবিধ অনন্যতায় উদ্ভাসিত এক ইবাদতের নাম হজ। একই সাথে এটি কায়িক ও আর্থিক ইবাদত। হজ কেবল সামর্থ্যবানদের ওপরই ফরজ; নামাজ-রোজার মতো ধনী-গরিব সবার জন্য জরুরি নয় এবং জীবনে একবার সম্পন্ন করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে ব্যক্তি (ঈমানদার) কাবাঘরে পৌঁছতে সম হয় তার ওপর আল্লাহর প্রাপ্য হচ্ছে, সে যেন হজ করে’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৬)।
হজ বিপুল সওয়াব, রহমত, বরকত আর মর্যাদায় পরিপূর্ণ। যার জীবনে একবারও হজ পালন নসিব হয় সে অতি সৌভাগ্যবান। মুমিনের জীবনে হজের চেয়ে মহান আর কোনো ইবাদত নেই। হজের মাধ্যমে মুমিনদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের এ আগমন হবেÑ যেন তারা তাদের কল্যাণের স্থানে পৌঁছে’ (সূরা হজ : ২৮)।
একজন হজ পালনকারী গোনাহমুক্ত নতুন জীবন প্রাপ্ত হয়। তার জীবন পবিত্রময় হয়ে ওঠে। অতীতের সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়। সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ থেকে ফিরে আসেন। হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করল, যৌন সম্পর্কযুক্ত অশ্লীল কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এলো’ (বুখারি ও মুসলিম)। আবু মূসা রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘হজ পালনকারী তার পরিবারের ৪০০ লোকের ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারবেন। আর হজ পালনকারী তার গোনাহগুলো থেকে এমনভাবে নিষ্পাপ হয়ে যান, যেমন তার মা তাকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ করেছিলেন’ (বাযযার)। আর একটি গোনাহমুক্ত কবুল হজের প্রতিদান সরাসরি জান্নাত। আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘গোনাহমুক্ত গ্রহণযোগ্য হজের একমাত্র বিনিময় আল্লাহর জান্নাত’ (বুখারি ও মুসলিম)।
হজ পালনকারী যখন ইহরাম পরে এ মহান ইবাদতে মশগুল হয় তখন তার সম্মানার্থে চার পাশের সৃষ্টিজগৎও অংশগ্রহণ করে। সাহল ইবনে সাদ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলমান ইহরাম পরে তালবিয়া পড়তে থাকে, তখন তার ডান ও বামের পাথর, বৃ, মাটিকণা এমনকি জমিনের ওপর প্রান্ত থেকে নিচের সর্বশেষ প্রান্ত পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকে, (তিরমিজি)। হজরত আবদুল্লাহ বিন ওমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তুমি যখন হজ পালনকারীর সাথে সাাৎ করো, তখন তাকে সালাম দাও এবং মোসাফাহা করে তার ঘরে প্রবেশ করার আগে তোমার গোনাহ মাফের জন্য দোয়া করতে বলো, কেননা হজ পালনকারী গোনাহমুক্ত হয়ে এসেছে’ (আহমাদ)।
হজ ও ওমরাহ পালনকারীরা মহান আল্লাহর মেহমান। ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধে বিজয়ী, হজকারী ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। আল্লাহ তাদের আহ্বান করেছেন, তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আর তারা তাঁর কাছে চেয়েছেন এবং তিনি তাদের দিয়েছেন’ (ইবনে মাজা)। হজের উদ্দেশ্যে বের হলে প্রতি কদমে নেকি লেখা হয়, গোনাহ মাফ করা হয় এবং তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তুমি যখন বায়তুল্লাহর উদ্দেশে নিজের ঘর থেকে বের হবে, তোমার বাহনের প্রতিবার মাটিতে পা রাখা এবং পা তোলার বিনিময়ে তোমার জন্য একটি করে নেকি লেখা হবে এবং তোমার গোনাহ মাফ করা হবে’ (তাবরানি)। শুধু তা-ই নয়, হজের নিয়তে বেরিয়ে মারা গেলেও হজের সওয়াব হতে থাকে। আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশ্যে বের হলো, এরপর সে মারা গেল, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজের নেকি লেখা হতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি ওমরাহর উদ্দেশ্যে বের হয়ে মারা যাবে, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত ওমরাহর নেকি লেখা হতে থাকবে’ (তারগিব ওয়াত-তারহিব)।
হজের অনুপম পালনীয় বিধান দেখে শয়তান হতাশায় পড়ে যায়। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আরাফাত দিনের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে অন্য কোনো দিনই আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন না’ (মুসলিম)। হজরত তালহা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আরাফাতের দিন (হজের দিন) শয়তানকে সর্বাধিক হীন, পেরেশান, ইতর ও ক্রোধান্বিত দেখা যায়, কারণ এ দিন আল্লাহর সীমাহীন রহমত বর্ষণ ও বান্দার বড় বড় গোনাহ মাফের বিষয়টি শয়তান দেখে থাকে।’
হজে শুধু পরকালীন নয়, ইহকালীন কল্যাণও হাসিল হয়। হজ ও ওমরাহ পাপমোচনের পাশাপাশি হজকারী ও ওমরাহকারীর অভাব-অনটনও দূর করে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরাহ পরপর করতে থাকো, কেননা তা অভাব ও গোনাহ দূর করে দেয়, যেমন রেত লোহা, সোনা ও রুপার মরিচাকে দূর করে দেয়’ (তিরমিজি)।
এভাবে অসংখ্য হাদিসে হজের ফজিলত বর্ণিত আছে। তাই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পালন না করা বা বিলম্ব করা মোটেও উচিত নয়। সাহাবায়ে কেরাম রা: এবং আমাদের আকাবির বুজুর্গানে দ্বীন অনেক কর্মব্যস্ততার মধ্যেও অনেকবার হজ পালন করেছেন। ইমাম আজম আবু হানিফা রহ: সুদূর কুফা থেকে এসে ৫৫ বার হজ পালন করেছেন। এমন কল্যাণ পেতে বিলম্ব না করে সামর্থ্যবানদের এখনই হজের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement