হজের ধারাবাহিক কার্যক্রম
- ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
- ১৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০
হজের বাংলায় লেখা বইগুলো পড়লে বেশ মুশকিলে পড়তে হয়। সাধারণের জন্য কিভাবে হজের মৌলিক কার্যক্রমগুলোকে পালন করতে হয় তা বুঝতে বেশ কষ্ট হয়ে যায়। আর তাই হাজীদেরও অপেক্ষা করতে হয় প্রত্যেক প্রহরে ‘মুয়াল্লিম’ কী দিকনির্দেশনা দেবেন তার জন্য। কিন্তু এসব কার্যক্রম, তার গুরুত্ব এবং পালনের দিনক্ষণ ও নিয়মাবলি যদি আগেই জানা যায় তাহলে পূর্ব প্রস্তুতি যেমন গ্রহণ করা সম্ভব হবে তেমনি কার্যক্রমগুলো যথাযথ গুরুত্বের সাথে পালন করা শুধু সহজই হবে না বরং তা আনন্দেরও হবে।
ইহরাম (নিয়ত করা): আমাদের মিকাত হলো ‘ইয়ালামলাম’ পাহাড়। এখান থেকে নিয়ত করতে হবে। নিয়ত করা ফরজ। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকেও করা যায়। কিন্তু কেউ যদি আগে মদিনায় যায় তাহলে সেখান থেকে মক্কার যাওয়ার পথে ইহরাম বাঁধা উত্তম। আমরা বাংলাদেশীরা যেহেতু ‘হজে তামাত্তু’ করে থাকি তাই প্রথমে ওমরাহের নিয়ত করতে হবে। নিয়ত করেই তালবিয়া পড়তে শুরু করতে হবে। তিনবার জোরে পাঠ করা সুন্নত। ইহরামের পোশাক পরাই ইহরাম নয় বরং নিয়তটাই ইহরাম।
ওমরাহ করা : মক্কায় প্রবেশ করেই সম্ভব হলে ওমরাহ শেষ করে নেয়া। তা না হলে হোটেলে মাল-জিনিসপত্র রেখে অহেতুক সময় নষ্ট না করে ওমরাহের জন্য কাবা শরিফে চলে যেতে হবে। ওমরাহের কাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো: তাওয়াফ করা (ফরজ) (সহিহ মুসলিম, ২১৩৭)। সাত চক্করকে এক তাওয়াফ বলা হয়। প্রথম তিন চক্করে রমল (বীরত্ব প্রদর্শনে দ্রুত হেঁটে চলা) (সহিহ বুখারি, ১৫০১) ও ইজতিবা করা (ইহরামের কাপড় ডান হাতের নিচে দিয়ে বাম কাঁধের ওপর রাখা) জরুরি। পরবর্তী চার চক্কর স্বাভাবিকভাবে শেষ করা। (সুনানুত তিরমিজি, ৭৮৭)
সাঈ করা (ওয়াজিব) : সাফা থেকে শুরু করে মারওয়া পাহাড়ে শেষ হবে। সর্বমোট সাতবার প্রদক্ষিণ করা। হালক করা বা মাথা মুণ্ডন করা (ওয়াজিব)। হজ শুরু হওয়ার কাছাকাছি সময়ে হলে চুল খাটো করে ফেলা। যাতে হজ শেষে আবার মাথা মুণ্ডন করা সম্ভব হয়। এখন আপনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন। ইহরামের সময়ে নিষিদ্ধ কাজ থেকে অব্যাহতি পাবেন। এ সময়ে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগি করবেন।
হজ মৌলিক কার্যক্রম শুরু : ৮ জিলহাজ : ইয়াওমুত তারবিয়্যাহ (তারবিয়্যাহর দিন) ফজরের সালাতের পরে সকালের নাস্তা সেরে তাড়াহুড়া না করে গোসল করে হজের নিয়ত করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেই মিনার দিকে রওনা হবেন। (নিয়ত করা ফরজ) মিনায় পৌঁছে এইদিন বিশেষ কোনো কাজ নেই। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে হবে এখানে। এখানে অবস্থানের সময় বেশি বেশি করে ইবাদত, বন্দেগি, দোয়া-জিকর, কুরআন তিলাওয়াত ও হাদিস অধ্যয়ন করবেন।
৯ জিলহজ : আরাফাতের দিন। সকালের নাস্তা সেরে ধীরে-সুস্থে আরাফাতের দিকে রওনা হবেন। ইমাম সাহেবের খুতবা শুনবেন। মসজিদে নামিরার আশপাশে থাকার চেষ্টা করবেন। জোহর ও আসরের সালাত এক আজানে দুই ইকামতে কসর ও জমা (দুই ওয়াক্ত একসাথে আদায়) করবেন। এখানের দোয়া কবুল হয়। বেশি বেশি করে দোয়া করবেন। যেকোনো দোয়া করতে পারেন। তবে, ‘লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু ওয়া লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি সায়্যিন ক্বদির’ দোয়ায় বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। সূর্য ডোবার (মাগরিবের আজানের) আগে কেউ বের হবেন না। এরূপ করলে দম (কুরবানি) ওয়াজিব হবে।
মুজদালিফা (৯ জুলাইয়ের দিনগত রাত) : সূর্য ডোবার (মাগরিবের আযানের) পর মুজদালিফার দিকে রওনা হবেন।
পথে মাগরিবের সালাতের সময় শেষ হয়ে গেলও আদায় করবেন না। বরং মুজদালিফায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে, পবিত্র হয়ে মাগরিব এবং এশার সালাত কসর (তিন রাকাত মাগরিব এবং এশার দুই রাকাত এবং বিতর) আদায় করবেন। রাতে সামর্থ্য থাকলে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি করতে পারেন। বাধ্যবাধকতা নেই। মুজদালিফা থেকে ৭০টি (৭+২১+২১+২১) খেজুরের বিচি বা তার চেয়ে ছোট ধরনের পাথরের কুচি এখান থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারেন। মিনা থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু কখনো কখনো তা কঠিন হয়ে যায়।
১০. জিলহজ : ইয়াওমুন নাহার/ঈদের দিন (মিনা-এর কার্যক্রম) : এদিন শুধু বড় জামারাতে (তৃতীয় জামারত) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। এটি ওয়াজিব। কঙ্কর নিক্ষেপ শেষে জামারাতকে বাম পাশে রেখে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করবেন। এখন আর তালবিয়া পাঠ করার দরকার নেই। কুরবানির টাকা আগেই দিয়ে থাকলে আপনার কুরবানি হয়ে গেছে এই ভেবে মাথা মুণ্ডন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনি হালাল অবস্থায় ফিরে আসলেন। অর্থাৎ সেলাই করা কাপড় সহ অন্যান্য স্বাভাবিক হালাল কাজগুলো করতে পারবেন। অথবা যদি মনে করেন যে ১৩ তারিখে তাওয়াফ ও সাঈ করে মাথা মুণ্ডন করে হালাল হবেন তাও করতে পারেন। মাথা মুণ্ডন করা ওয়াজিব। এ দিন সম্ভব হলে এখান থেকেই কাবাতে গিয়ে তাওয়াফ (ফরজ) ও সাঈ (ওয়াজিব) করে মিনায় ফিরে আসবেন। আর সেটা সম্ভব না হলে কংকর নিক্ষেপ করেই সরাসরি মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন এবং রাতে মিনায় থাকবেন। মিনায় অবস্থানকালীন সালাতগুলো কসর করবেন কিন্তু জমা’ বা একাধিক ওয়াক্তকে একসাথে করবেন না।
১১ জিলহজ : এই দিন সূর্য ঢলে পড়ার পর ২১টি কঙ্কর নিয়ে জামারাতের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন এবং সেখানে পৌঁছে ছোট জামারাতকে সাতটি, মধ্যমটাকে সাতটি এবং বড়টাকে স্তকি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। যদি ১০ তারিখে তাওয়াফ ও সাঈ না করে থাকেন তাহলে এদিন তাওয়াফ ও সাঈ করে আসতে পারেন। তা না হলে মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন এবং রাত যাপন করবেন।
১২ জিলহজ : এদিন মক্কায় ফিরে আসা যায় আগের দিনের মতো এদিনও ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন এবং আগে তাওয়াফ ও সাঈ না করে থাকলে আজ করতে পারেন। এরপর মিনার তাঁবুতে ফিরে আসবেন এবং রাত যাপন করবেন। সূর্যাস্তের আগে কঙ্কর নিক্ষেপ করা শেষ করতে পারলে ওইদিন মক্কায় ফিরে আসতে পারবেন। তবে মিনায় রাত যাপন করা সুন্নত।
১৩ জিলহজ : যদি এদিন মিনায় থাকেন, তাহলে আগের দিনের মতো আজো ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরবেন। যদি তাওয়াফ ও সাঈ না করে থাকেন তাহলে আজ তা পালন করতে পারেন। যদি এদিন মিনাতে থাকেন তাহলে ১৪ তারিখে আবারো ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে তারপর মক্কায় ফিরে আসবেন। আগে তাওয়াফ করে থাকলে এখন আর তাওয়াফ ও সাঈ করার দরকার নেই।
তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ী তাওয়াফ (ওয়াজিব) : মক্কা ত্যাগ করার আগেই এ তাওয়াফ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে সাঈ করা জরুরি নয়। কিন্তু যদি কেউ আগের তাওয়াফ ও সাঈ না করে থাকেন তাহলে একই নিয়তে তাওয়াফ শেষে সাঈ করে বিদায় নিবেন।
উল্লেখ্য, বিদায়ী তাওয়াফ করার পরেও যদি কেউ মক্কায় একদিন থাকে তাহলে তাকে আবারো বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে।
মদিনায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর রওজা জিয়ারত :হজের আগে কিংবা পরে অবশ্যই মদিনা মুনাওয়ারা এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর রওজা মুবারক জিয়ারত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে তা হলো: মক্কার মতো মদিনাও পবিত্র ভূমি। এখানে শায়িত আছেন রাসূলুল্লাহ সা: সহ তাঁর অসংখ্য সাহাবি। এ ভূমির পবিত্রতা রক্ষা করা তাই খুবই জরুরি। প্রতিটি পদক্ষেপে এটি স্মরণ রাখা জরুরি। মসজিদে নববীতে সালাত আদায়। (১ রাকাত সমান ৫০ হাজার রাকাত)
‘রওজাতু মিন রিয়াজুল জান্নাতে’ সালাত আদায়। মসজিদে নববীর সামনে রাসূলুল্লাহ সা- এর রওজা মুবারকের ঠিক ডান পাশের কিছু অংশে সাদা রঙের ভিন্ন কারপেট বিছান। এই স্থানকে রাসূলুল্লাহ সা: জান্নাতের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এ ‘রওজাতু মিন রিয়াজুল জান্নাতেই’ রাসূলুল্লাহ সা:-এর মিহরাব ও মুসাল্লা অবস্থিত। সাদা-কালো পাথরের এই মিহরাবেই রাসূলুল্লাহ সা: সালাত আদায় করতেন। সম্ভব হলে অপরকে কষ্ট না দিয়ে এখানে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করতে পারেন।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর রওজা জিয়ারত এবং সালাম দেয়া। এটি মসজিদে নববীর ঠিক সামনের বাম দিকে অবস্থিত। বাইরে থেকে যে সবুজ গম্বুজটি আমরা দেখি এটি রাসূল সা:-এর রওজা। এখানে শায়িত আছেন তাঁর প্রিয় অন্য দুইজন সাহাবি হজরত আবু বকর ও ওমর রা:। তাদেরকেও সালাম দেয়া।
ফেরার পথে ও পরবর্তী জীবনে করণীয় : হজ থেকে ফেরার পথে এ বিশ্বাস নিয়ে ফেরা যে আপনার হজটি ‘হজে মাবরুর’ বা কবুল হয়েছে আর আপনি সে দিনের মতো হয়ে গেছেন, যেদিন আপনি প্রথম মায়ের গর্ভ থেকে এ পৃথিবীতে এসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ করল এবং কোনো খারাপ বা অশ্লীল কাজ ও কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখল সে যেন সে দিনের মতো হয়ে গেল, যে দিন সে এ পৃথিবীতে এসেছিল। (বুখারি)
লেখক : শিক্ষাবিদ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা