২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চুল-দাড়িতে খেযাব শরিয়তের বিধান

-

যুগ-জমানা, চাল-চলন, আহার-বিহার ও স্থান-পাত্রের পরিবর্তন-বিবর্তনে চার দিকে পরিবেশে সব কিছুতেই কেমন যেন পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। গত দুই দশক আগেও সার্বিক অবস্থা-পরিস্থিতি যেমনটি দেখা যায়নি, বর্তমানে তা-ই যেন অধিক হারে ঘটছে। উদাহরণ ফল-ফসল, খাদ্য-খাবারে ফরমালিন ইত্যাদি ব্যবহার ও তার একটা কুপ্রভাব মানবদেহে, শরীর-স্বাস্থ্যে বিস্তৃত। একইভাবে অল্প বয়সে চুল পড়তে শুরু করা বা সাদা হয়ে যাওয়া বিষয়টি, যা ইতঃপূর্বে অনেকটা ব্যতিক্রম ব্যাপার ছিল, তা এখন যেন অনেকটা ব্যাপক হারেই ঘটছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে খেযাব ইত্যাদি ব্যবহারে জড়িয়ে পড়ছেন। আবার এতে আমলদার সাধারণ মুসলমানের পাশাপাশি মুত্তাকি আলেম-ইমামদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ বিষয়টি সম্পর্কে অনেক সহিহ হাদিসে নেতিবাচক বর্ণনা বিদ্যমান; যদিও ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো হাদিসে তার বৈধতার কথাও দেখা যায়। যে কারণে ইদানীং বিষয়টি নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হচ্ছে অনেক বেশি তাই মানসিক তাড়া থেকে কিছুটা লেখার এ প্রয়াস।
চুল দাড়িতে খেযাব ব্যবহার প্রশ্নে যেসব রঙ ব্যবহার করা হয়। তা ‘আসওয়াদে খালিস’ বা মিশমিশে কালো যেমন হতে পারে, তেমনি ‘সাধারণ কালো’র কাছাকাছি ‘কাতাম’ বা ‘ওসমা’ তথা ব্রাউন কালো বা হাল্কা কালো বা অধিক ও গাঢ় লালের কারণে দেখতে কালোর কাছাকাছি মনে হওয়া; লাল, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি যেকোনো রঙ হতে পারে।
হাদিসের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা কেবল ‘মিশমিশে কালো’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অপরাপর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
হাদিসের নিষেধাজ্ঞা প্রতারণা-প্রবঞ্চনার ক্ষেত্রে এবং যেক্ষেত্রে বৃদ্ধাবস্থা ও যৌবনাবস্থা সংশয়ের দরুন বোঝা মুশকিল হয় সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু যদি তেমন সংশয় না হয়, বরং কালো খেযাব ব্যবহারের পরেও বয়সের ছাপ এমনিতেই চেহারা দৃষ্টে বা অন্যান্য অঙ্গ-অবয়ব দৃষ্টে বোঝা যায়; তাহলে সে ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘিত হয় না। যদিও হাদিসের ব্যাপক অর্থ বিবেচনায় এবং গবেষণা বিতর্ক হলেও বেঁচে থাকার বিবেচনায়, তা ব্যবহার না করাই উত্তম বলে বিবেচিত হবে।
রোগ-ব্যাধি, দূষিত খাদ্যদ্রব্য পানাহারের দরুন বা দূষিত আবহওয়া ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির দরুন যদি অসময়ে বা অল্প বয়সেই সাদা হয়ে যায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে এবং রোগ-ব্যাধির ক্ষেত্রে ‘ব্যতিক্রম বৈধ’ বিবেচনায় কালো খেযাব ব্যবহার অবৈধ বলা হবে না।
দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি একজন মানুষের অন্যতম বিশেষ প্রয়োজন ও আবশ্যকীয় ব্যাপার। এটিকে হাল্কা করে দেখার অবকাশ নেই। যে কারণে কোনো স্বামী নিজ স্ত্রীর সন্তোষ ও আকর্ষণের নিমিত্তে বা বিশেষ বিবেচনায় কালো খেযাব ব্যবহার করলে, সেটিকে অবৈধ বলা হবে না।
হাল্কা কালো, বাদামি, ধূসর-কালো বা ব্লাক-ব্রাউন রঙ, যা মিশমিশে কালো নয় এবং তা ব্যবহারে সংশ্লিষ্টকে তরুণরূপে দেখায় না বা বোঝা যায় না; তেমন খেযাব ব্যবহারের অবৈধতা হাদিসে নেই। বরং বিভিন্ন হাদিসের ‘কাতাম’ ও ‘ওসমা’ শব্দ দ্বারা এমন কালো খেযাব ব্যবহারের বৈধতা ও উৎসাহ প্রমাণিত হয়।
লাল রঙ, মেহেদি রঙ, হাল্কা বা গাঢ় যাই হোক, হলদে রঙ ও সবুজ রঙ ইত্যাদি ব্যবহারের বৈধতা সরাসরি বহু হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়। সুতরাং এসব খেযাব ব্যবহারে কোনো বাধা নেই; বরং উত্তম।
উল্লেখ্য, খেযাব সংশ্লিষ্ট রঙ বলতে এমন রঙ যা স্বাভাবিক উদ্ভিদজাত যেমন মেহেদি ইত্যাদি কিংবা এমন তৈলজাতীয় রঙ যাতে পানি ভেদ করতে পারে। কিন্তু খেযাব যদি এমন পেইন্টজাতীয় রঙ দ্বারা হয়, যা পানিতে ভেদ করতে পারে না যেমন নেইল পলিশ ইত্যাদি। তাহলে তেমন কোনো প্রকার খেযাব ব্যবহার করা আদৌ জায়েজ নেই। কেননা, তাতে পানি ভেদ করতে না পারায় সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীর অজু, গোসল ইত্যাদি সহিহ-শুদ্ধ হয় না। এমনকি জানাজার গোসলও শুদ্ধ হয় না। মোটকথা, চুল-দাড়িতে কালো খেযাব ব্যবহারের মূল ও সাধারণ বিধান মাকরুহ তাহরিমি যেমন সঠিক, তেমনি প্রয়োজন ও বৈধতার ব্যতিক্রমী বিধানও শরিয়তসম্মত। উল্লেখ্য, ওই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ‘আহসানুল ফাতাওয়া’ সূত্রে ‘মাকরুহে তাহরিমি’ লেখা বিষয়টিও সঠিক। তবে তা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; কেবল তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা ওপরে আলোচিত কোনো কারণ বা সমস্যা ছাড়াই ‘কালো খেযাব’ ব্যবহার করেন; অথবা আলোচিত প্রতারণার লক্ষ্যে তা ব্যবহার করেন।
যেসব ইমাম ও খতিব মহোদয় ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ওই বিস্তারিত আলোচনার নিরিখে, যে ক্ষেত্রে তাদের কারো আলোচিত বৈধতাজ্ঞাপন কোনো কারণ বা সমস্যা থাকে সে ক্ষেত্রে আইনত তারাও খেযাব ব্যবহার করতে পারেন। তবে সাধারণত আমাদের সমাজের মুসল্লিদের মধ্যে এরূপ বৈধ-অবৈধ ক্ষেত্রের পার্থক্যজ্ঞান না থাকায়; তারা সব বিধানকে একাকার করে ফেলে এবং সবার সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়। তাই তেমন সমালোচনা হতে বেঁচে থাকার জন্য ও অধিক তাকওয়া ও নৈতিক দায়িত্ববোধ রক্ষাকল্পে ইমাম ও খতিব মহোদয়দের ‘কালো খেযাব’ ব্যবহার না করাই শ্রেয় বলে বিবেচিত হবে। তার পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে (বিশেষত কমিটি-কর্তৃপক্ষের) যে, আইন-বিধান প্রয়োগধর্মী হয়ে থাকে ও নৈতিকতা বিবেকধর্মী হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো ইমাম বা খতিব সংশ্লিষ্ট বৈধ কোনো প্রয়োজনে যদি ‘কালো খেযাব’ ব্যবহার করেন তা হলে এ ওজুহাতে তাকে পদচ্যুত করতে পারবেন না।
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন


আরো সংবাদ



premium cement