যখন খুশি আকাশে ওড়ার প্রযুক্তি কি শেষ পর্যন্ত মানুষের নাগালে?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০১ আগস্ট ২০২১, ২২:৩৯
লী কোটসের মতে, যখন একটি জেটপ্যাক পিঠে বেধে আপনি বাতাস ভেদ করে ছুটতে থাকেন, তখন আপনার মনে হবে আপনি যেন একজন সুপারহিরোর মতোই আকাশে উড়তে পারেন।
এই অনুভূতিটা অবিশ্বাস্য, বলছেন এই অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন হেলিকপ্টার পাইলট। আপনার আসলেই মনে হবে, আপনি উড়তে পারেন। তবে বলতেই হচ্ছে এই জেটপ্যাক ব্যবহার করা বেশ কঠিন।
জেটপ্যাকের কথা বিশ্ব প্রথম জানতে পারে ১৯৬৫ সালে, জেমস বন্ড মুভি থান্ডারবলের সৌজন্যে। তখন জেমস বন্ড চরিত্রে অভিনয় করতেন শন কনারি। ছবিতে দেখা যায়, এই গুপ্তচরকে ধাওয়া করছে বন্দুকধারীরা, এক বাড়ির ছাদ থেকে তখন জেটপ্যাক পরে আকাশে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এই নাটকীয় দৃশ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল থান্ডারবল ছবিটি। যে জেটপ্যাকটি সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল সেটির নাম 'বেল টেক্সট্রন।' ১৯৫০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এই প্রযুক্তি তৈরি করে 'মানুষ-রকেট' হিসেবে। তবে শেষ পর্যন্ত মার্কিন সামরিক বাহিনী এই প্রযুক্তি আর ব্যবহার করেনি, কারণ তাদের মতে এটি ছিল খুবই বিপদজনক।'
তবে সিক্রেট এজেন্ট জিরো-জিরো-সেভেনের জন্য এটি বেশ ভালোই কাজে লেগেছিল, অন্তত শন কনারির জায়গায় যে স্ট্যান্টম্যান এটি পরে উড়েছিলেন।
৫৬ বছর পর এখন জেটপ্যাক প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন নানা ধরন বিশেষ কাজে এটি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। যেমন কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত উদ্ধারকর্মী পাঠানোর কাজে, কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনীতে।
ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীর এক সদস্যের পরীক্ষামূলকভাবে জেটপ্যাক ব্যবহারের একটি নাটকীয় ভিডিও সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, হেলিকপ্টার থেকে দড়ি দিয়ে জাহাজে নামার পরিবর্তে এক মেরিন সেনা জেটপ্যাক ব্যবহার করে জাহাজে উড়ে যাচ্ছেন।
তবে বিনোদনমূলক কাজেও যে জেটপ্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে, সেটা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা দেখা যায় না। পর্যবেক্ষকরা এক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে নিরাপত্তা থেকে শুরু করে পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ-এরকম নানা বিষয় আছে। একজনের পিঠে যখন একটা জেটপ্যাক বেঁধে দেয়া হচ্ছে, তখন কীভাবে তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা হবে, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভূমিকা কী হবে, এরকম নানা বিষয়।
তবে দুটি প্রতিষ্ঠান, যার একটি যুক্তরাষ্ট্রের এবং একটি যুক্তরাজ্যের, এখন যে কাউকেই অর্থের বিনিময়ে জেটপ্যাক পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ দিচ্ছে। তবে জেটপ্যাক পরে এই পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সময় তাদের তার দিয়ে বড় একটি ফ্রেমের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা হচ্ছে, যাতে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যে কোন দিকে উড়ে যেতে না পারেন।
জেটপ্যাক কি তাহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে যাচ্ছে? এই প্রযুক্তির যেসব সমস্যা এখন আছে, সেগুলো কি কাটানো যাবে?
আমার মনে হয় বিনোদনের মতো কাজে ব্যাপক ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে এই প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত থাকবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে, বলছেন নিউ ইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল এন্ড এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এর এসোসিয়েট প্রফেসর বেনজামিন আকিহ।
আমি দমকল কর্মী, মেডিক্যাল এবং উদ্ধারকর্মী, বা সম্ভবত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য-এদের কথাই বলছি...এসব বিশেষ ক্ষেত্রে জেটপ্যাকের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হওয়ার পর অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার শুরু হবে, যেমন বিনোদন বা ব্যক্তিগত ভ্রমণের কাজে।
ড্যানিয়েল লেভিন নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আভান্ট গাইড ইনস্টিটিউটের ট্রেন্ড এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত ভ্রমণ এবং কনজুমার ট্রেন্ডের ওপর নজর রাখে।
ড্যানিয়েল লেভিনের ধারণা, বিনোদনের কাজে গণহারে জেটপ্যাক তৈরি করা হবে, এমন সম্ভাবনা কম। তবে অনেক অর্থ খরচ করে জেটপ্যাক ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নেয়ার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক একটা বিষয়ে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, আমার মনে হয় আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে রোমাঞ্চপ্রিয় বিত্তশালীরা কোনো কোনো দেশে হয়তো জেটপ্যাক ভাড়া করতে পারবেন, সেখানে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোও তাদের ফূর্তি করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। আমার দৃষ্টি থাকবে দুবাইর দিকে।
এই প্রযুক্তি যখন গড়পড়তা মানুষের ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠবে, তখন আকাশে ওড়ার এই প্রযুক্তি একটা জায়গা করে নেবে, প্রাথমিকভাবে একটি রোমাঞ্চকর যাত্রার বাহন হিসেবে।
'ইনসাইড ট্রাভেল ল্যাব' নামে একটি ওয়েবসাইট চালান অ্যাবি কিং। তিনিও একমত যে, যারা রোমাঞ্চপ্রিয়, তাদের মধ্যে জেটপ্যাক জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
আমার বিশ্বাস উত্তেজনাকর নতুন কিছুর জন্য আগ্রহ সবসময় থাকবে। একবার আপনি স্কাইডাইভ (প্যারাস্যুট নিয়ে আকাশ থেকে ঝাঁপ দেয়া) এবং বাঙ্গি জাম্পের (পায়ে দড়ি বেঁধে উঁচু জায়গা থেকে ঝাঁপ দেয়া) অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেলার পর নতুন কি? সবাই হয়তো এভাবে ভাবে না, কিন্তু যারা নিত্যনতুন রোমাঞ্চকর চ্যালেঞ্জের পেছনে ছুটছে, তারা এভাবেই চিন্তা করে।
জেটপ্যাক প্রযুক্তিতে যেসব প্রতিষ্ঠান ভালো অবস্থান গড়ে নিয়েছে তাদের মধ্যে আছে ক্যালিফোর্নিয়ার জেটপ্যাক এভিয়েশন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে। এই প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে তাদের 'জেবি' সিরিজের বেশ কিছু জেটপ্যাক তৈরি করেছে।
জেটপ্যাক এভিয়েশন মূলত সামরিক এবং জরুরি সেবা খাতে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে একই সঙ্গে তারা বিবেচনায় রেখেছে বিনোদন খাতও। যেমন তাদের জেবি-১০ জেটপ্যাকটি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশনের অনুমোদন পাওয়া। এটির টুইন-টার্বোজেট ইঞ্জিন চলে কেরোসিন বা ডিজেলের মতো জ্বালানি দিয়ে। এই জেটপ্যাক এখন তারা লোকজনকে ভাড়া দেয় প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য।
জেটপ্যাক এভিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী ডেভিড মেম্যান বলেন, তাদের দুই দিনের জেটপ্যাক প্রশিক্ষণের যেরকম চাহিদা তৈরি হয়েছে, সেটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক।
যে পরিমান মানুষকে আমরা প্রশিক্ষণের জন্য নিতে পারি, তার চেয়ে অনে বেশি মানুষ আগ্রহ দেখাচ্ছে, বলতে পারেন একটা উন্মাদনা তৈরি হয়েছে।
মিস্টার মেম্যান তার কোম্পানির তৈরি জেটপ্যাককে বর্ণনা করছেন আকাশপথে চলা সেগওয়ে হিসেবে। তার মতে, এটি চালানো সহজ। যিনি এই জেটপ্যাক চালাবেন, তার গতি নিয়ন্ত্রিত হবে ডান হাতে, আর বাঁ হাতে থাকবে দিক পরিবর্তনের নিয়ন্ত্রণ। জেটপ্যাকের জ্বালানির অবস্থা, ইঞ্জিন, ব্যাটারির অবস্থা এগুলো জানা যাবে একটা কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে।
গড়পড়তা সাইজের একজন গড়পড়তা স্বাস্থ্যের মানুষের এটি চালাতে মোটেই কোনো অসুবিধা হবে না, বলছেন মিস্টার মেম্যান। আমরা এ পর্যন্ত যত লোককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, তার ভিত্তিতে আমরা এটা বলছি। আপনাকে একজন দক্ষ বৈমানিক হতে হবে বা পাইলট হতে হবে, মোটেই তা নয়। সত্যি কথা বলতে কী, তাদের বেলায় বরং জিনিসটা আয়ত্বে আসতে বেশি সময় লাগে, কারণ তাদেরকে আগে শেখা অনেক জিনিস এখানে ভুলে যেতে হয়।
জেটপ্যাক এভিয়েশন এপর্যন্ত প্রায় ৮০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। মিস্টার মেম্যান জানান, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ থেকে অনেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন সেখানেও এধরনের প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চালু করার জন্য।
তবে এটা এখনো অত সস্তা নয়, দুই দিনের প্রশিক্ষণের জন্য ৪ হাজার ৯৫০ ডলার লাগে।
মিস্টার মেম্যান বলেন, এটা একটা ব্যয়বহুল কাজ, কারণ আমরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তা বেশ ব্যয়বহুল। তবে আমার মনে হয় সামনে খরচ কমে আসবে, কারণ ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উন্নতি হবে।
যুক্তরাজ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বী একটি কোম্পানি গ্র্যাভিটি ইনডাস্ট্রিজ সাধারণ মানুষকে তাদের জেটপ্যাক পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ দিচ্ছে। তবে এখানেও জেটপ্যাক ব্যবহারকারীকে নিরাপদ রাখার জন্য একটি তার দিয়ে সংযুক্ত রাখা হয়।
যুক্তরাজ্যের রাজকীয় নৌবাহিনীকেও গ্র্যাভিটি তাদের তৈরি জেটপ্যাক সরবরাহ করছে পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর জন্য।
জেটপ্যাক এভিয়েশন এবং গ্র্যাভিটি এভিয়েশন, এই দুটি প্রতিষ্ঠানই জানিয়েছে, তারা জেটপ্যাক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে যাচ্ছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে এই প্রতিযোগিতা হবে পানির ওপর।
গ্র্যাভিটি আসলে তাদের প্রথম জেটপ্যাক প্রতিযোগিতা ২০২০ সালের মার্চে বারমুডায় চালু করতে চেয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তাদের সেটি স্থগিত রাখতে হয়।
গ্র্যাভিটির প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড ব্রাউনিং একজন সাবেক তেল ব্যবসায়ী এবং রয়্যাল মেরিনের রিজার্ভ সেনা। তিনি বলছেন, তারা যে প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা করছেন, সেখানে সম্ভবত সাধারণ মানুষকে জেটপ্যাক চালানোর প্রশিক্ষণও দেয়া হবে, যাতে তারা বিভিন্ন ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
আমরা চাই এটা নিজের গতিতেই বেড়ে উঠুক, তবে প্রচুর মানুষকে আমরা প্রশিক্ষণ দেব, এমনটাই আমরা ভাবছি।
এরা হবে ধনী এবং ক্যারিশম্যাটিক ধরনের নারী-পুরুষ। যখন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে যাবে, আমরা তখন মোনাকো বা সানফ্রান্সিসকো বে এরিয়ার মতো কোন বিখ্যাত জায়গায় হয়তো মিলিত হবো। আমরা তাদের কোম্পানির রঙে তাদের জেটপ্যাক তৈরি করে দেবো।
তিনি বলেন, এই প্রতিযোগিতার সময় হতো প্রতিযোগীদের তাদের জেটপ্যাক নিয়ে কিছু উচু টাওয়ারের চারদিকে ছুটতে হবে, নানা কসরৎ করতে হবে। তিনি বলেন, জেটপ্যাকের এই ফ্লাইট হয়তো বড়জোর পাঁচ বা ছয় মিনিটের বেশি হবে না।
মিস্টার ব্রাউনিং বলেন, কয়েক মাস পর পর হয়তো এই প্রতিযোগিতা বিশ্বের বিখ্যাত কিছু জায়গায় হতে পারে। এরকম একটা মডেলের কথাই আমরা ভাবছি। আমরা আসলে এটা বলার চেয়ে দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাই।
লী কোটস আশা করছেন তিনি গ্র্যাভিটি ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন। ২০১৯ সালে তিনিই আসলে প্রথম কোনো নারী যিনি গ্র্যাভিটির জেটপ্যাক নিয়ে আকাশে ওড়েন, এবং সেটি কোনো তারের সঙ্গে বাঁধা না থাকা অবস্থায়।
লী কোটস থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায়। জেটপ্যাক নিয়ে আকাশে উড়বো, এটি ছিল আমার শৈশবের স্বপ্ন, বলছেন তিনি। আমি যখন এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জানতে পারলাম, তখন আমি সুযোগ লুফে নেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা