নিজের ও পরিবারের সুরক্ষায় সচেতন হতে হবে
- শাহেদ মতিউর রহমান
- ২০ জুন ২০২০, ০৯:৩৪, আপডেট: ২০ জুন ২০২০, ০৮:৪৯
করোনা অদৃশ্য রোগ। যে কেউ এই রোগে যেকোনো সময়েই আক্রান্ত হতে পারেন। অনেক সময় এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো উপসর্গও থাকে না। আবার সাধারণ জ¦র বা সর্দি-কাশিতে হাসপাতালে দৌড়ানোও ঠিক হবে না। করোনার প্রাদুর্ভাবের এই সময়টাতে প্রত্যেকেরই উচিত নিজের ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সচেতন থাকা। স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ও করোনা চিকিৎসা শাখার সমন্বয়ক ডা: মোক্তাদির ভুইয়া নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এসব কথা।
নয়া দিগন্ত : আপনি তো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার শুরু থেকেই এই বিভাগে আছেন। হাসপাতালে রোগীদের ভর্তির ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : আমরাতো চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিন থেকেই বলে আসছি খুব বেশি জরুরি না হলে করোনা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির কোনোই প্রয়োজন নেই। বাসায় থেকেই সাধারণ রোগীদের মতো করোনার রোগীও চিকিৎসা নিতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে তাকে আলাদা একটি কক্ষে আইসোলেশনে থাকতে হবে। অর্থাৎ বাসার অন্য সদস্যদের সংস্পর্শ থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে। আর জটিল রোগীদের ক্ষেত্রেই শুধু আমরা ভর্তির কথা বলি।
নয়া দিগন্ত : করোনা রোগের সাধারণ উপসর্গ বা জ¦র সর্দি থাকলেই কি করোনার পরীক্ষা করাতে হবে?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : দেখুন, করোনা রোগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই পরীক্ষার সহজলভ্যতা এখনো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেনি। বেসরকারিভাবে কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে এই পরীক্ষার কিছুটা সুযোগ থাকলেও খরচের বিবেচনায় সবার পক্ষে এই পরীক্ষা করাও কঠিন। আবার সরকারিভাবে পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও সেখানে অনেকেই নানাভাবে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়েও নানা কথা আছে। তারপরেও সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট ও কার্যকর উদ্যোগ রয়েছে।
নয়া দিগন্ত : প্রান্তিক পর্যায়ে করোনা পরীক্ষার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা যদি না-ই থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে জনগণের আসলে করণীয় কী?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : ধরুন, পরীক্ষায় কোনো একজনের করোনা পজিটিভ হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে তিনি কী করবেন? অবশ্যই প্রথমে তিনি নিজেকে অন্যদের সংস্পর্শ থেকে সরিয়ে নেবেন। করোনা রোগী হিসেবে তিনি বিশেষ একটি রুটিন মেনটেইন করবেন। খাবার মেনু এবং অন্যান্য কিছুর বিষয়ে তিনি সতর্ক থাকবেন। তাহলে পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা না করেইতো আমরা আগেই সতর্ক হতে পারি। কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে পারি। আর এই সতর্কতা মানতে হবে আমাদের নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার জন্যই।
নয়া দিগন্ত : করোনার পরীক্ষা কাদের জন্য বেশি জরুরি?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : যে বা যারা সম্মুখ (ফ্রন্ট) লাইনে থেকে কাজ করেন, বিশেষ করে করোনার এই মহামারীর সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগ তথা হাসপাতালগুলোতে সর্বদা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন এমন ডাক্তার, নার্স ও অন্য কর্মকর্তাদের করোনা পরীক্ষা করাটা বেশি জরুরি। আবার অন্য দিকে যৌথ ফ্যামিলিতে সেখানে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি এবং একজনের সংক্রমিত হওয়ার ফলে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে সে ক্ষেত্রেও ওই পরিবারের কারো করোনা উপসর্গ দেখা দিলে তাকে পরীক্ষা করাটা জরুরি। যাতে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাকে অন্যদের সংস্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া যায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপদ রাখতেই তখন ওই একজনের পরীক্ষাটা করা জরুরি।
নয়া দিগন্ত : করোনার ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার আসলে কতদূর?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : করোনার ওষুধ নিয়ে একটি ভুল ধারণা এখনো সবার মধ্যেই কাজ করছে। সত্যিকার অর্থে করোনার সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই, আসবেও না। করোনার এই ওষুধের ধারণা নিয়েও অনেক ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে। মনে রাখতে হবে ওষুধ আবিষ্কার হলেও করোনা রোগের সরাসরি কোনো ওষুধ আসলে থাকবে না। তবে হ্যাঁ, যে ওষুধটি আবিষ্কার হবে সেটি হবে শুধু করোনা বা মৃত্যুঝুঁকি কমানোর ওষুধ। অদূর ভবিষ্যতে ওষুধ আবিষ্কার হলেও সেটি দিয়ে হয়তো করোনা রোগীর ইনফেকশন কমবে। করোনা রোগ সারানোর মতো সরাসরি কোনো ওষুধ আসবে না।
নয়া দিগন্ত : অদৃশ্য রোগ করোনা থেকে আমরা কিভাবে আমাদের পরিবারকে সুরক্ষা করতে পারি?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : পরিবার শুধু নয়, আমরা যদি আমাদের দেশকেও করোনা থেকে সুরক্ষা করতে চাই তাহলে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো আমাকে নিজেকে আগে সুরক্ষা করতে হবে। তবেই আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশ করোনা থেকে বেঁচে যাবে, সবাই শতভাগ সুরক্ষা পাবে। তাই আমি নিজেকে আগে সুরক্ষা করব। আর আমরা নিজেরা যদি প্রত্যেকে নিজেদের অবস্থান থেকে সচেতন হই, সতর্ক থাকি তাহলেই অন্যরা নিরাপদ থাকবে। মনে রাখতে হবে আমি নিজে যেন অন্যের শরীরে করোনার জীবাণু ছড়িয়ে না দেই। আমার কারণে যেন কোনো একজনও করোনায় আক্রান্ত না হন। আমি যেমন আমার নিজের ও আমার পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করি তেমনি প্রত্যেকেই তার নিজের এবং তার পরিবারেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চান।
নয়া দিগন্ত : সরকারের পক্ষ থেকেতো প্রথম দিকেই লগডাউনের মতো কড়া নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। তারপরেও কেন করোনা নিয়ন্ত্রণ করা গেল না?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : লগডাউনের ধারণাই মানুষ প্রথম দিকে বুঝতে পারেনি। সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিন। যারা এই লগডাউন কার্যকর করতে মাঠে-ময়দানে নেমেছিলেন, তারা কি সঠিকভাবে এটা বাস্তবায়ন করাতে পেরেছেন? পুলিশ ও সেনাবাহিনী মাঠে থাকা অবস্থায় কিছুটা হয়তো লগডাউন মানা হয়েছে, কিন্তু পরে আগের যেই-সেই অবস্থাই চোখে পড়েছে। ফলে প্রথম দিকের লগডাউন বাস্তবে কোনো কাজে আসেনি।
নয়া দিগন্ত : আপনি তাহলে কোন পদ্ধতিতে কার্যকর লগডাউনের কথা বুঝাতে চাইছেন?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া: আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকই আসলে ‘লগডাউন’ এই শব্দের সাথেই পরিচিত ছিলেন না। এমনকি কারফিউর মতো অবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কেও তারা জানেন না। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে বটে। কেননা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ দেশের মানুষকে এমন লগডাউন বা শাটডাউনের মতো কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। এ ক্ষেতে যে বিষয়টি করা যেত তাহলো শহরগুলোকে লগডাউনের আওতায় নিয়ে সেখানে অন্য শহরের লোকজনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা যেত। অর্থাৎ প্রত্যেক শহর থেকে প্রত্যেক শহর বিচ্ছিন থাকুক। এতে করোনার এই শহরভিত্তিক লোকাল ট্রান্সমিশনটা এভাবে ছড়াত না।
নয়া দিগন্ত : আপনি কি বোঝাতে চাইছেন এই পদ্ধতি শহরগুলোকে করোনা মুক্ত রাখা যেত?
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : পাঠকদের অবশ্যই স্মরণে থাকার কথা, ঢাকা শহরে যখন করোনা রোগী প্রথম শনাক্ত হয় তখন কিন্তু চট্টগ্রামে কিংবা রংপুরে একটি রোগীও পাওয়া যায়নি। ওই সময়েই যদি শহরগুলোকে লগডাউনের আওতায় নিয়ে এসে ঢাকা শহর থেকে অন্য শহরগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা যেত তাহলে হয়তো সারা দেশে এভাবে করোনা রোগটি ছড়িয়ে যেত না। এরপরেও বলব সরকার এখন যেভাবে রোগটি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে তাতে আমরা যদি আরো বেশি সতর্ক হই, নিজেদের অবস্থান থেকে দায়িত্বশীলতার পরিবচয় দিতে পারি তাহলে আশা করছি আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরাও শিগগিরই করোনা থেকে মুক্ত হতে পারব।
নয়া দিগন্ত : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা: মোক্তাদির ভুইয়া : আপনাকে ও নয়া দিগন্তকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।