২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বিশেষ সাক্ষাৎকারে খন্দকার মাহবুব হোসেন

রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় খালেদা জিয়া জেলে

-

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছর জেলে আছেন। তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনের কথা বলছেন আইনজীবীরা। বলছেন, রাজপথ উত্তপ্ত করতে না পারলে খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন না। এই প্রেক্ষাপটে কোন পথে খালেদা জিয়া মুক্ত হতে পারেন তা নিয়ে নয়া দিগন্তকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও রাজনৈতিক কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে অর্থাৎ দলীয় সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। আর এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, আমি এখনো বিশ্বাস করি- এই সরকারের দুর্নীতি, জুলুমবাজি জনমনে যেভাবে বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে একসময় হয়তো একটি গণবিস্ফোরণ ঘটবে। সেখানে হয়তো আমাদের নেতার কোনো প্রয়োজন হবে না। স্বাভাবিকভাবে মানুষ জেগে উঠবে এবং বর্তমান স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

 

নয়া দিগন্ত : আপনি বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম সদস্য। আপনি দীর্ঘদিন যাবৎ ওনার জামিনের ব্যাপারে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আপনি এ কথাও বলেছেন যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খালেদা জিয়ার কারামুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওনার মুক্তির পথ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি- রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ও রাজনৈতিক কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে অর্থাৎ দলীয় সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিবেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কারণ আমরা জানি, পাঁচ বছর, সাত বছর সাজা হলে যদি উচ্চ আদালতে আপিল করা হয় সাথে সাথে তার জামিন দেয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে আপনারা দেখেছেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে জামিন দেয়া হয়নি। আমাদের আইনে এরকম বিধান রয়েছে, যদি কোনো বয়স্ক ও অসুস্থ মহিলা থাকেন তবে তার জামিনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ আবেদন থাকে। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত যে, সাত বছরের সাজায় তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে বলতে গেলে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া হয়নি। আমি এখনো মনে করি বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জেলে রাখা হয়েছে। যে পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছা না হবে তত দিন পর্যন্ত আইন অঙ্গন থেকে তাকে জামিনে মুক্ত করা সম্ভব হবে না।

নয়া দিগন্ত : আপনি বিভিন্ন সময় বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে রাজপথ উত্তপ্ত করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনানুগভাবে কিভাবে মানুষ রাজপথে আন্দোলন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আইনানুগভাবে তো রাজপথ উত্তপ্ত হবে না। আমরা আইনানুগভাবে যদি যাই তখন তো বাধা আসে। আমি বলতে চাই- একটি দেশ এভাবে একটি অবৈধ সরকারের অধীনে দীর্ঘদিন থাকতে পারে না। সমাজের সর্বস্তরে হত্যা-গুম, দুর্নীতির যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, এর ফলে হয়তোবা একসময় একটি সাহসী নেতৃত্বের আবির্ভাব হবে এবং সেই সাহসী নেতৃত্বের পেছনে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়বেন। দেশ উদ্ধার হবে, গণতন্ত্র কায়েম হবে এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন।

নয়া দিগন্ত : বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৬টি মামলা আছে, যার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার জামিন আবেদনটি আপিল বিভাগে আছে এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওনার জামিন আবেদন সরাসরি খারিজ করার পর আরেকটি বেঞ্চ ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় সামনে আপনাদের আর কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : আমরা অবশ্যই আইনের বিধান মোতাবেক চেষ্টা করব। কিন্তু বিচারিক আদালতে যে ধরনের বিচার পাওয়া উচিত ছিল আমরা সেই ধরনের বিচার পেয়েছি কি না সেখানে আমাদের দ্বিমত রয়েছে।

নয়া দিগন্ত : বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দুই বছর কারাভ্যন্তরে আছেন এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের বাইরে আছেন। এর ফলে বিএনপি নেতৃত্ব সঙ্কটে অসুবিধায় পড়ছে কি না? আপনার মতামত কী?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : এটাকে অস্বীকার করার উপায় নাই যে, বিএনপিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দুর্বলতা রয়েছে। আরেকটা বিষয় দেখতে হবে- যারা এখন আমাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক, জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন, তাদের অনেকেরই বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা রয়েছে। সে কারণেও কিছুটা মানসিকভাবে দুর্বলতা তাদের রয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে সাহস করে কিছু বলা তাদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়। তাই এখানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অবশ্যই একটি সাহসী ভূমিকা নিতে হবে। আর সাহসী ভূমিকা যদি তারা নিতে সক্ষম না হন তবে তাদের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তাভাবনা করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা আছে বলে আমি মনে করি না।

নয়া দিগন্ত : আপনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি একটি বিশাল দল, সারা দেশে আপনাদের লাখ লাখ কর্মী রয়েছেন। যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আপনারা আইনজীবীরা তাদের কতটুকু সহায়তা দিতে পারছেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, আমাদের বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে আছেন এবং যারা বাইরে আছেন তাদের অনেককে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। যারা জামিনে আছেন তাদের একটি সময় মামলায় হাজিরা দিতে হচ্ছে। এই কারণে বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এটা সত্য যে, আমাদের নেত্রী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। এই ক্ষেত্রে আমরা মনে করি তার মুক্তি সম্ভব, দেশে যদি একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মানুষ যেন ভোট দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আমরা যারা নেতৃত্ব দিচ্ছি তারা ব্যর্থ হচ্ছি। এবং যত দিন পর্যন্ত আমরা এ থেকে উদ্ধার না পাব তত দিন পর্যন্ত আমাদের ভাগ্যে আমরা বিশেষ কিছু আশা করতে পারি না।

নয়া দিগন্ত : সরকার এককভাবে সবকিছু করছে অর্থাৎ একক নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিরোধী দল বলতে বিএনপিকে বুঝায়। সরকারের এই একক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিএনপি কার্যকর কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আপনার মনে হয়?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখেন, পারছে না। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। না পারারও একটা কারণ রয়েছে। যে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শত শত মামলা রয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামের কোনোরকম পদক্ষেপ নিলেই বিশেষ করে গ্রামপর্যায়ে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আপনারা ঢাকা শহরে দেখছেন কোনোরকম পুলিশের অনুমোদন ছাড়া আমরা কোনো মিটিং-মিছিল করতে পারি না। সে ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে হলে আমি এখনো বিশ্বাস করি এক সময় একটি সফল নেতৃত্ব আসবে। বিশেষ করে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জেলে এবং আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষে অনেক সময় এ দেশের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই কারণে আমাদের কিছুটা দুর্বল নেতৃত্ব রয়েছে।

নয়া দিগন্ত : আইন অঙ্গনে আপনি দীর্ঘদিন আছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে আপনার আইন পেশায় প্র্যাকটিস শুরু। এই পেশায় যখন এসেছেন তখন যা দেখেছেন আর বর্তমানে যা দেখছেন এর মধ্যে কী পার্থক্য দেখছেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : এই সুদীর্ঘ ৫০ বছর আইন অঙ্গনে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। আমরা যখন প্রথম বারে এসেছিলাম তখন আমরা দেখেছি, বিচারক তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করেন এবং আইন মাফিক বিচার করেন। সেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা ব্যক্তিগত প্রভাব থাকত না। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখতে পাচ্ছি- আইন অঙ্গনেও বিভিন্নভাবে বিচার ক্ষেত্রে প্রভাবান্বিত হচ্ছে। মানুষ এ কথা মনে করেন। তাই একটি কথা মনে রাখতে হবে- বিচার বিভাগ হলো জনগণের শেষ আশ্রয় স্থল। এই আশ্রয় স্থলটি যাতে কোনো মতে, কোনোভাবে কলঙ্কিত না হয়। প্রভাবমুক্ত থাকে সেটা আমাদের সবাইকে দেখতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমান যে অবস্থা তার অবশ্যই পরিবর্তন হতে হবে।

নয়া দিগন্ত : একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে চাই। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছিলেন। সম্প্রতি দেখা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় এখন কি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : দেখুন, বাকশাল হওয়ার আগে আমাদের প্রথম সংবিধানে ছিল- নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ বিশেষ করে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল সংসদের। পরবর্তী সময়ে বাকশাল হয়, এটা এককভাবে বিচারকদের নিয়োগ, অপসারণ রাষ্ট্রপতির আওতায় নেয়া হয়। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে নিজে রাষ্ট্রপতি থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই ক্ষমতা খর্ব করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অনুযায়ী বিচারকদের যদি অপসারণ করতে হয়, তিনজন সদস্য থাকবেন- প্রধান বিচারপতি এবং তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুইজন বিচারপতি। পঞ্চম সংশোধনীতে সেটাকে বহাল রাখা হয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি না থাকে তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় সর্বক্ষেত্রে নেয়া হয় সে ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস রয়েছে যে, বিচারকদেরও রাজনৈতিক আক্রোশে তাদের সরিয়ে দেয়া হতে পারে। এজন্য পার্লামেন্টের কাছে এটি না দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এখনো বহাল আছে। আরেকটা বড় বিষয় হলো আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে দল থেকে একজন সংসদ নির্বাচিত হবেন তাকে অবশ্যই সে দলকে সমর্থন দিতে হবে যেকোনো ভাবে। তার ফলে দেখা যাচ্ছে, যদি কোনো সরকারি দল বিচারকের অপসারণ করতে চায় সে ব্যাপারে তাদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংসদে নাই। সরকার যেটি চাবে তাদের সেই মতামতের ভিত্তিতে ভোট দিতে হবে। এখনো তিনজন বিচারকের ব্যাপারে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে সেটাও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতায় করা হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।


আরো সংবাদ



premium cement