২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
নয়া দিগন্তকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল

নির্বাচনের মধ্য দিয়েই পরিবর্তন চায় বিএনপি

- ছবি : নয়া দিগন্ত

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি কোনো বিল্পবী দল নয়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও বিশ্বাস করে না দলটি। তাই সরকার পরিবর্তনে নির্বাচন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই বিএনপির সামনে। আন্দোলন ছাড়া যে নতুন নির্বাচন আদায় সম্ভব নয়, তাও জানিয়েছেন তিনি।

মির্জা ফখরুল মনে করেন, হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নয়, বিএনপিকে পথ চলতে হবে ঠাণ্ডামাথায়। একাদশ সংসদের মতো একটা অস্বাভাবিক নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে তাদের এখন মূল কাজই হচ্ছে হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের জাগিয়ে তোলা। তাদের স্বপ্ন দেখানো। একই সাথে রাজনীতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হলে আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে একসাথে সোচ্চার হতে হবে। দাবি আদায়ে জনগণকেও নিয়ে আসতে হবে রাজপথে।

সম্প্রতি নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব এসব কথা বলেন। বিস্তারিত এ সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি, এর ভবিষ্যৎ, একাদশ নির্বাচন প্রসঙ্গ ও বিএনপির আগামী দিনের পথ চলা নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১৬ সালের মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে তিনি প্রায় সাড়ে চার বছর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে মির্জা ফখরুল দু’টি জাতীয় নির্বাচন পার করেছেন।

সর্বশেষ একাদশ নির্বাচনে তিনি বগুড়া-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু শপথ নেননি। নির্বাচিত হওয়ার পরেও শপথ না নেয়ার এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম ঘটনা। নির্বাচনের আগে তার অগ্রণী ভূমিকায় গঠিত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কোনো কোনো মহলে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সমালোচনা থাকলেও রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, বিএনপির সাথে এক মঞ্চে ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর বর, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের আনতে পারাটা ছিল রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট। সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল যা বলেছেন :

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই এ দেশের রাজনীতি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়েছে, বর্তমান রাজনীতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ কী?

মির্জা ফখরুল : প্রথম বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের যে রাজনীতি চলছে, এটাকে অ্যাসেস করাই আমাদের অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। গত এক দশক ধরে অর্থাৎ এক-এগারোর পর থেকে বাংলাদেশে রাজনীতির যে ধারা চলছে তা সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া, পলিটিক্যাল লিডার্স কেউই আমরা এর গতি-প্রকৃতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারিনি বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। প্রকৃত অর্থে বিশ্বায়নের এ সময়ে বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন এলাকা নয়। গোটা বিশ্বেই রাজনীতির চরিত্র পাল্টে গেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাজনীতির একটি ভিন্ন রূপ ছিল। এ সময়ে উদার গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের উত্থান ঘটেছে। বিশ্ব মানবতা তখন আত্মঅধিকারের দিকে, গণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের পর আবার পরিবর্তনটা হয়েছে ভিন্ন ধরনের। এ সময়ে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার দানবীয় আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট দেশ ও জাতিসত্তাগুলোকে বড় কুমিরেরা (বৃহৎ দেশগুলো) খেয়ে ফেলে। এতে ছোট দেশগুলোর নিজস্ব সত্তা কমতে থাকে। বড়রা রাজনীতি ও অর্থনীতিকে খেয়ে ফেলে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ও ঘটেছে অধিকার আদায়ের একটি দুর্নিবার তাগাদা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ ৯ মাসে শেষ হয়েছে, এর মূল কারণ প্রতিবেশী বড় দেশ ভারত আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অন্যথায় ৯ মাসে যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো কারণই থাকত না। সেখানেও বড় ধরনের মেরুকরণ হয়েছে। তারপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ’৭২ থেকে ’৭৪ সালের মধ্যে গণতন্ত্রকে সেই দলই বাতিল করেছে, যারা গণতন্ত্রের জন্যই সংগ্রাম করেছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের দিকে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মৌলিক বিচ্যুতি সে সময়ই ঘটেছে।

এরপর সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এটাও কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। জিয়াউর রহমানের হাত ধরে দেশে পুনরায় যখন বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে, ফ্রি ইকোনমি এলো, মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসতে শুরু করল, তখন আবারো এ যাত্রা ব্যাহত হলো জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে। এর সাথে এরশাদ একাই জড়িত ছিলেন না, অন্য দেশগুলোও জড়িত ছিল। বিশ্বায়নের বিষয়টিও সম্পর্কিত ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুস্থভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ কখনোই দেয়া হয়নি। যার ফলে এখানে সুস্থ রাজনীতির ধারাই সৃষ্টি হয়নি।

আজ যখন আমরা প্রকৃত গণতন্ত্রের বা উদার গণতন্ত্রের কথা বলি, তখন অনেকেই সে বিষয়টি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। অবাক লাগে, আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন, পত্রপত্রিকায় লিখছেন, টকশোতে কথা বলছেন, তারা এ ব্যবস্থাটাকে মনে হয় মেনেই নিয়েছেন। অনেকে আবার বলছেন বাকশালই ঠিক ছিল। এটি হচ্ছে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার সঙ্কট।

আপনি বলছেন কোনো কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপে এখানে সুস্থ রাজনীতির ধারা সৃষ্টি হয়নি। এর সাথে কি একাদশ সংসদ নির্বাচনের যোগসূত্র আছে?

মির্জা ফখরুল : ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল একেবারেই অস্বাভাবিক একটি নির্বাচন। নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। বিশ্বায়নের যে বিষয়টা আমি বলেছি, সামগ্রিকভাবে তারা মনে করেছে এ সরকারই তাদের জন্য ভালো। কারণ এ সরকার তাদের দ্রুত ব্যবসা দিতে পারছে, সব দিয়ে দিতে পারছে। সরকারও তাদের সাথে ভালোভাবে মিশে যেতে পেরেছে। ফলে ৩০ ডিসেম্বরের এমন একটি নির্বাচনের পরেও সরকার চাপে পড়তে পারে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া কারো পক্ষ থেকে দেখিনি। আমরা যারা রাজনীতি করছি, সবাই কি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এ বিষয়গুলো বিবেচনা করছি? করছি না। আমরা কি এটা ভাবছি যে, বাংলাদেশের রাজনীতি আর বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করছে না?

তাহলে বিএনপি এখন কি করবে ?

মির্জা ফখরুল : ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি এবং তাদের জোট স্বভাবতই এলোমেলো। সবার মাঝে হতাশা কাজ করছে। এখন সবাইকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। এতে কিছুটা সময় লাগছে।

আপনারা কি সচেতনভাবে একাদশ নির্বাচনে গেছেন ?

মির্জা ফখরুল : আমরা সচেতনভাবেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এত অত্যাচার নিপীড়ন নির্যাতনের পর আমাদের মধ্যে এ শঙ্কা ছিল যে, নির্বাচনে জিততে দেয়া হবে না, সব কেড়ে নেয়া হবে, তারপরেও আমরা নির্বাচনে গেছি। কারণ আমাদের তো দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। বিএনপি তো কোনো বিপ্লবী দল নয়, সন্ত্রাসী দল নয়। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই, বন্দুক নেই। আমাদের জনগণকে সাথে নিয়েই ন্যূনতম যে সুযোগটা আছে, তা ব্যবহার করতে হবে। নির্বাচনে আমাদের শঙ্কাই প্রমাণিত হয়েছে, তারা নির্বাচনের ফল আগেই নিয়ে গেছে।

এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, নেতাকর্মীদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে তাদের হতাশা থেকে বের করে আনা। তাদের স্বপ্ন দেখানো। এটি অনেক কঠিন কাজ। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও আমাদের হারিয়ে দেয়ার পর আমরা ঘরে বসে গিয়েছিলাম। পার্লামেন্টে কেউ যাবেন না বলে মত আসে। পরে আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। তখন ছিলেন ৩০ জন। তারা পার্লামেন্টে গিয়ে বলেছেন আমরা নির্বাচন মেনে নেইনি। কেবল গণতন্ত্রের স্বার্থেই আমরা সংসদে এসেছি।

এবারো তো সংসদে যোগ দেয়া নিয়ে অনেক হইচই হলো

মির্জা ফখরুল : আমি সংসদে যোগ দেয়াকে খুবই যৌক্তিক মনে করেছি। কারণ আমাদের তো আর কোনো স্পেস নেই। আমরা কোথাও দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি না। কয়েক দিন আগে দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি র‌্যালি বের করতে চেয়েছি, দেয়া হয়নি। ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংসদে আজ যারা আছেন, রুমিন বলেন আর হারুন বলেন, তারা কথা বলছেন, গোটা পৃথিবী শুনছে। বিভিন্ন বিষয় উঠে আসছে।

তাহলে আপনি কেন গেলেন না ?

মির্জা ফখরুল : আমি কৌশলের অংশ হিসেবে যাইনি। এ নির্বাচন দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ মেনে নেননি। সংসদে বিএনপি যাক জনগণ তা চাননি। কিন্তু কথা বলার ন্যূনতম স্পেসের সুযোগ নিতে জনগণের স্বার্থে বিএনপি সংসদে গেছে। অন্য দিকে জনগণের আবেগকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তাই সংসদে যাওয়ার পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমনি প্রতিবাদেরও দরকার আছে বলে মনে করেছি। এ জন্য শপথ নেইনি। তাতে সংসদে গিয়ে বিএনপির কথা বলার সুযোগ রইল। পাশাপাশি প্রতিবাদ জানানোকেও নেতাকর্মী এবং জনগণ স্বাগত জানিয়েছেন। এসবের কোনো কিছুই দল ও হাইকমান্ডের সম্মতি ছাড়া হয়নি।

পার্লামেন্টে আপনাদের দলের এমপিদের ভূমিকায় কী আপনি সন্তুষ্ট?

মির্জা ফখরুল : আমি তো দেখছি আমাদের কয়েকজন বেশ ভালো বলছেন। এটাই আমরা চাচ্ছি, তারা কথাগুলো তুলে ধরুক। দায়িত্বশীল পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তাদের যে ভূমিকা, সেটা তারা বলুক। আর যেসব কালাকানুন আসবে, সেগুলোকে তারা বাধা দেবেন।

শপথ নেয়ার সাথে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্পর্ক আছে, এ রকম গুঞ্জনের সত্যতা কতটুকু?
মির্জা ফখরুল : এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।

৩০ ডিসেম্বরেরর নির্বাচনের দিন সকালে ঠাকুরগাঁওয়ে ভোটের পরিবেশ সম্পর্কে আপনার একটি বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা রয়েছে,

মির্জা ফখরুল : আমার বক্তব্য আসলে অনেকেই বুঝতে পারেননি। আমার সামনে দু’টি ব্যাপার ছিল। একটি হচ্ছে ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে ভোটাররা ডিমোরালাইজড (হতাশ) হয়ে না যান। আরেকটি হচ্ছে, ভোটাররা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে যাতে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দেন।

অভিযোগ ছিল, আগের রাতেই ৩০ ভাগ বা তার বেশি ভোট দেয়া হয়ে গেছে, তাহলে সে বিষয়টি আপনি কেন তুলে ধরনেনি?

মির্জা ফখরুল : আমার ওখান থেকেও নিয়েছে। কিন্তু আমি তো তখন এ বিষয়টি বলতে পারি না। সেটা যদি আমি উল্লেখ করতে যাই, তাহলে ভোটাররা হতাশ হবেন, মনে করবেন ভোট দিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ আমি তখনো আশা করছি, যদি আমার ভোটাররা ভোট দিতে আসতে পারেন, তাহলে আমি ভোটে জিতে যাবো। আমার আসনে মাত্র দুই ঘণ্টা ভোট হয়েছে, এক লাখ ২৫ হাজার ভোট পেয়েছি। সুতরাং কৌশলের ব্যাপার রয়েছে। ওই একটি বক্তব্য নিয়ে সব কিছু ধ্বংস করে ফেলল, সেটি ঠিক না। ওই মুহূর্তে ওইভাবে কথা না বললে, অন্যান্য কেন্দ্রে বা আসনে যে সামান্য ভোট হয়েছে, সেটিও হতো না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করেই তো কথা বলতে হবে।

নির্বাচনে আপনাদের দাবি ছিল সেনা মোতায়েন। তাদের ভূমিকায় আপনারা কতটুকু সন্তুষ্ট?

মির্জা ফখরুল : একদম সন্তুষ্ট নই। আমরা খুব হতাশ হয়েছি। তারা নির্বাক পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। কোথাও কোথাও তাদের বলেও আমরা কোনো ফল পাইনি।

নির্বাচনের আগে সারা দেশে পুলিশের অনিয়মের একটি তালিকা নির্বাচন কমিশনে আপনারা জমা দিয়েছিলেন, এতে কী প্রশাসন আরো বিপক্ষে চলে যায়নি? এমন তালিকা দেয়া কি সঠিক ছিল?

মির্জা ফখরুল : আমরাই তো দিয়েছি। এখন বেঠিক বলি কী করে?

নির্বাচনের পরই ফল প্রত্যাখ্যান করে শপথ না নেয়া এবং পরবর্তী সব নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েও পরে কেন তা পরিবর্তন করলেন ?

মির্জা ফখরুল : সব কিছু দলীয় কৌশলেরই অংশ। ফল প্রত্যাখ্যানের বিষয় থেকে আমরা এখনো সরে আসিনি। যে নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি সে নির্বাচনে ফল প্রত্যাখ্যান করাই স্বাভাবিক।

দশম সংসদে অংশ না নেয়া এবং একাদশ সংসদে অংশ নেয়ার দু’টি সিদ্ধান্তই কি সঠিক ছিল?

মির্জা ফখরুল : দু’টি সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। এ বিষয়টি প্রমাণ করতে একাদশ সংসদে দল অংশ নিয়েছে। এ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। এ জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন করাটা জনগণের গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছেন বলে দলটির নেতা মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

মির্জা ফখরুল : একটি মিথ্যা কথা কিভাবে কখন বললে জনগণ সত্য বলে মেনে নেবে এ কৌশল খুব ভালো জানেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। সব ধরনের রাজনৈতিক কৌশলই জানেন তারা। সেসব নেতাদের একজন মোহম্মদ নাসিম। যেহেতু ঐক্যফ্রন্টে অস্থিরতা চলছে বলে একটি গুজব নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে, সে সুযোগে নাসিম সাহেব এমন একটা বক্তব্য দিয়েছেন, যাতে সবাই বিশ্বাস করেন।

নির্বাচনে ড. কামালের ভূমিকা কেমন ছিল?

মির্জা ফখরুল : গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা ছিল শতভাগ ইতিবাচক। তার মতো ভদ্র, দেশপ্রেমিক, সৎ-সাহসী রাজনীতিবিদ খুব একটা পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে ড. কামালকে বিএনপি সামনের দিকে আনার চেষ্টা করেছে। অন্য দিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপির রঙটা সবসময় জামায়াতের সাথে লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্র রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। সব মিলে বিএনপির সাথে ড. কামাল, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের আনতে পারাটা রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট। দেশ ও রাজনীতির স্বার্থে এটাকে সবার প্রশংসা করা উচিত।

ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ কী?

মির্জা ফখরুল : ভবিষ্যৎ তো ভালোই মনে করি। শুধু ঐক্যফ্রন্ট নয়, ২০ দলকে আরো সম্প্রসারিত করতে হবে। রাজনীতিতে সুস্থ ধারা আনতে হলে আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে একসাথে সোচ্চার হতে হবে।

২০ দলীয় জোটের বন্ধন কি অটুট আছে?

মির্জা ফখরুল : হ্যা, তাতো আছেই। কোনো সমস্যাতো দেখছি না।

বিএনপির আগামী দিনের সাংগঠনিক ও আন্দোলনের পরিকল্পনা কী?

মির্জা ফখরুল : রাজপথের কঠোর আন্দোলনের পরিস্থিতি বা সুযোগ কোনোটাই এখন নেই। দল গোছানো হচ্ছে। ভুল বোঝাবুঝির অবসান এবং নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে অঙ্গসংগঠনগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা এখন প্রধান কাজ। দলের চেয়ারপারসন কারাগারে আছেন, এখন সেটাই দলের সবচেয়ে বড় সঙ্কট। তিনি যতক্ষণ না বের হবেন ততদিন আন্দোলন গতি পাবে না। এ জন্য তাকে কিভাবে বের করে আনা যায় সে চেষ্টা হচ্ছে। মানুষকে রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠাণ্ডা মাথায় সামনের দিকে এগোতে হবে। তা না করা গেলে ফলপ্রসূ কিছু আসবে না।

আন্দোলন কবে নাগাদ শুরু হতে পারে?

মির্জা ফখরুল : তা বলা মুশকিল। অবশ্যই রোডম্যাপ তৈরি করা হবে। এ জন্য আগে দেখতে হবে দলীয় প্রস্তুতি আছে কি না। পরিস্থিতি অনুকূল কি না। কারণ এক লাখ গায়েবি মামলায় বিএনপির ২৬ লাখ নেতাকর্মী আসামি। এক হাজারের ওপরে নেতাকর্মী জেলে আছেন। এ পরিস্থিতিতে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না। অনেকে ’৯০ এর আন্দোলনের কথা বলেন। কিন্তু ১৯৯০ আর ২০১৯ যে এক না, এটা মাথায় রাখতে হবে। ’৯০ সালে এমন ভয়াবহ সরকার ছিল না। চরম নির্যাতনকারী সরকার ছিল না। তখন নির্বিচারে গুম, খুন, গুলি হতো না।

রাজপথের কঠোর আন্দোলন ছাড়া কি দাবি আদায় সম্ভব?

মির্জা ফখরুল : আন্দোলন তো লাগবেই। আমরা এখনই নতুন নির্বাচন চাচ্ছি। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমরা সরকারকে সরাতে চাই। এখন নির্বাচনও তো হবে না, যদি আন্দোলন না হয়।

আপনারা মধ্যবর্তী নির্বাচন চাচ্ছেন?

মির্জা ফখরুল : না আমরা বলছি, একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল বাতিল করে অবিলম্বে নতুন নির্বাচন দিতে হবে। মধ্যবর্তী নির্বাচন আলাদা জিনিস।

সেটি কি একাদশ না দ্বাদশ নির্বাচন?

মির্জা ফখরুল : আমরা এ বিষয়টি নিয়ে বসে দাবিগুলো চূড়ান্ত করব। তারপর আমরা সেভাবে কাজ করব।

সামনে সিটি করপোরেশন নির্বাচন, আপনারা কি করবেন?
মির্জা ফখরুল : আমরা পজিটিভলি চিন্তা করছি। এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি, তবে আমরা আগামীতে সব নির্বাচনের বিষয়েই পজিটিভলি চিন্তা করতে চাই।

কবে দলের সপ্তম কাউন্সিল করতে চান?

মির্জা ফখরুল : দ্রুত সময়ের মধ্যে দলের জাতীয় কউন্সিল করতে চায় বিএনপি। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট তারিখ ঠিক হয়নি। কাউন্সিলের আগে মূল কাজ হচ্ছে জেলা কমিটিগুলো আপডেট করা। এগুলো প্রায় শেষের দিকে। এগুলো শেষ হলে কাউন্সিলের প্রস্তুতি এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে।

নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা ফখরুল : আপনাকেও ধন্যবাদ।


আরো সংবাদ



premium cement