জি২০ সম্মেলন কী? বিশ্ব নেতারা কেন দিল্লিতে বৈঠকে বসছেন?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:০১, আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:০৪
আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা বার্ষিক জি২০ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন। এ বছরের সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। কিন্তু ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ বিষয়েও আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জি২০ কী?
জি২০ বা গ্রুপ অব টুয়েন্টি হচ্ছে কতগুলো দেশের একটি ক্লাব যারা বিশ্ব অর্থনীতির বিষয়ে পরিকল্পনার জন্য আলোচনা করতে বৈঠক করে।
জি২০-ভুক্ত দেশগুলোর আওতায় বিশ্ব অর্থনীতির ৮৫ শতাংশ এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনগণও রয়েছে এসব দেশে।
এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে- ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরো ১৯টি দেশ। এসব দেশ হচ্ছে - আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। স্পেন সব সময়ই অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে আমন্ত্রণ পায়।
জি২০-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেশ মিলে আবার জি ৭ গঠন করেছে।
জি২০-ভুক্ত কয়েকটি দেশ, যেমন- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে ব্রিকস নামে আরেকটি সংগঠন তৈরি করেছে।
এই সংগঠনটি আরো সম্প্রসারিত হওয়ার কথা রয়েছে। সবশেষ সম্মেলনে তারা নতুন ছয়টি দেশকে তাদের জোটে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এগুলো হচ্ছে, আর্জেন্টিনা, মিশর, ইরান, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
জি ২০ কী আলোচনা করবে?
সম্প্রতি জি২০-ভুক্ত দেশগুলোর আলোচনার পরিসর বেড়েছে। তাদের আলোচ্য সূচি শুধু অর্থনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই জ্বালানি, আন্তর্জাতিক ঋণ মওকুফ এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর করদানের মতো বিষয়ও আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে।
প্রতি বছর জি২০-ভুক্ত কোনো একটি দেশ সভাপতির দায়িত্ব নেয় এবং সম্মেলনের আলোচ্য বিষয় ঠিক করে। ২০২২ সালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিল ইন্দোনেশিয়া এবং জি২০ নেতাদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বালিতে।
২০২৩ সালের সভাপতি হিসেবে ভারত চায় দিল্লির এই সম্মেলন যাতে টেকসই উন্নয়নের প্রতি মনোনিবেশ করে এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যাতে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে সে বিষয়ে পদক্ষেপ আসুক।
এই সম্মেলনে জোটবদ্ধ আলোচনার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ এবং দারিদ্র নিরসনে বিশ্বব্যাংকের মতো বৈশ্বিক সংস্থার আরো বেশি পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে দেশগুলোর সাথে আলোচনা করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ক্রেমলিন অবশ্য জানিয়েছে যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই সম্মেলনে অংশ নেবেন না। এছাড়া চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-ও যে সম্মেলন থেকে দূরে থাকবেন সেটিও সংবাদমাধ্যমে বিস্তরভাবে প্রচার করা হয়েছে।
বিতর্কের বিষয় কী?
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের বিষয়টি দিল্লি সম্মেলনে বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২২ সালের মার্চে জি২০-ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কোনো চুক্তিতে সম্মত হতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার প্রতিনিধিদের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে তীব্র বিতর্কের কারণে।
২০২২ সালের নভেম্বরে বালিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বেশিরভাগ জুড়ে ছিল ইউক্রেনের সাথে পোল্যান্ডের সীমান্তের ভেতর পড়া যুদ্ধে ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্র সংকট নিয়ে আলোচনা।
মে মাসে চীন এবং সৌদি আরব ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত পর্যটন নিয়ে জি২০ সম্মেলন বয়কট করে। কারণ কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তান-দুই দেশই তাদের নিজেদের ভূ-খণ্ডের অংশ বলে দাবি করে।
ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত বিতর্কও এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি করেছিল যখন চীন অরুণাচল প্রদেশ এবং আকসাই চিন উপত্যকা তাদের নিজেদের ভূখণ্ড উল্লেখ করে একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছিল।
ভারতের জন্য সম্মেলনের গুরুত্ব কতটা?
সম্প্রতি গত কয়েক বছরে নিজেকে গ্লোবাল সাউথভুক্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে ভারত। আর জি২০-কে দেখা হচ্ছে তাদের এই আওয়াজ আরো বড় অঙ্গনে তুলে ধরার সুযোগ হিসেবে।
ভারতের ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে আগে শীর্ষ এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে এটি বিশ্বে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করবে।
দিল্লিতে এই সম্মেলনকে সামনে রেখে এর আগে ভারতের ৫০টি শহরে শত শত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মাসের পর মাস ধরে শহরগুলোতে জি২০ লোগো এবং মোদীর ছবি সম্বলিত উজ্জ্বল বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে। বিশ্বকে ভারতের নিয়ে আসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা হিসেবে এই অনুষ্ঠানকে দেখা হচ্ছে।
মোদীও জি২০-ভুক্ত অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়ন করেছেন বিশেষ করে গত জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাকে একটি উষ্ণ রাষ্ট্রীয় সফরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
চলমান জটিল বহু-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এই সম্মেলনে ভারতের জন্য একটি স্বস্তি-দায়ক হাওয়া আনবে বলে মনে হচ্ছে না।
অনেক অর্থনীতি এখনো মহামারীর থাবা থেকে বেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা যুদ্ধ এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে ক্রমে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে। কারণ বিশ্বজুড়েই খাদ্য এবং জ্বালানির দাম বেড়েছে।
সম্মেলনে ‘পারিবারিক ছবি’ কেন থাকে?
শীর্ষ সম্মেলনের শেষের দিকে সরকার প্রধানরা একটি গ্রুপ ছবি তোলার জন্য পেজ দেন যেটি ‘পারিবারিক ছবি’ বা ‘ফ্যামিলি ফটো’ হিসেবে পরিচিতি।
যাই হোক, এসব ছবিতে ফুটে ওঠা কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব অনেক সময়ই সংবাদের শিরোনামে পরিণত হয়।
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডের পর, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে বেশিরভাগ সময়েই উপেক্ষা করা হয়েছিল এবং তাকে গ্রুপ থেকে বেশ দূরে দাঁড়াতে দেখা গেছে।
জি২০-এর অর্জন কী?
২০০৮ এবং ২০০৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদক্ষেপ এসেছে এই সম্মেলন থেকে।
কিন্তু অনেক সমালোচনা বলেন যে, পরবর্তী সম্মেলনগুলো খুব একটা সফল হয়নি বিশ্বের শক্তিধর বিরোধী দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনার জের ধরে।
তবে সম্মেলনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলো বরাবরই ফলপ্রসূই ছিল।
২০১৯ সালে ওসাকায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বড় একটি বাণিজ্য দ্বন্দ্ব নিরসনে আলোচনা শুরু বিষয়ে একমত হন।
জি২০ সম্মেলন কি বিক্ষোভ উস্কে দেয়?
জি২০-ভুক্ত দেশগুলোর সম্মেলনকে ঘিরে প্রায় বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায়। ২০১০ সালে টরেন্টোতে এবং ২০১৭ সালে হামবুর্গে পুঁজিবাদ বিরোধী বিক্ষোভকারী বিক্ষোভ করে।
জি২০-এর অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ২০১৮ সালে রিও ডি জেনিরোতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বিক্ষোভ করে।
২০০৯ সালে ইয়ান টমলিনসন নামে একজন সংবাদপত্র বিক্রেতা লন্ডনে জি২০ সম্মেলনের সময় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের মাঝে পড়ে মারা যান। সূত্র : বিবিসি