আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস : প্রেক্ষাপট ও করণীয়
- মহিউদ্দীন ফারুকী
- ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:৪৫
আজ বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস। ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কোর উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়। এর আগে ১৯৭৩ সালে ১৮ ডিসেম্বর ষষ্ঠ ভাষা হিসেবে আরবি ভাষা জাতিসঙ্ঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে।
আরবি ভাষা কুরআনের ভাষা। মুসলমানদের হৃদয়ের সম্মানিত ভাষা। প্রায় ২৪ কোটি মানুষের মাতৃভাষা। এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি মুসলমানকেই অন্তত তার ইবাদত পরিশুদ্ধ করতে আরবি ভাষা শিখতে হয়। আর আলেম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস হতে হলে জানতে হয় আরো ভালোভাবে। দক্ষতা অর্জন করতে হয় ব্যাকরণে, সাহিত্যে।
অন্যদিকে সেমেটিক ভাষাগোত্রের মাঝে অনন্য এক অবস্থান নিয়ে আছে আরবি ভাষা। শুধু সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠিই নয়, পৃথিবীর সকল ভাষার মাঝে আরবি ভাষার রয়েছে সবচেয়ে উচ্চ ও উন্নত আসন। তাই বলা যায় আরবি ভাষা কালজয়ী ভাষা। কালের প্রবাহ কখনো এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। এই ভাষা স্থিতিশীল ও গতিশীল। পৃথিবীর সকল ভাষাতেই কোনো না কোনো সময় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু আরবি ভাষা আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রয়েছে অপরিবর্তনীয় ও অবিকৃত।
আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট
এত সম্মান ও উচ্চাবস্থান থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে আরবি ভাষা ছিল অনেকটা অবহেলার স্বীকার। আন্তর্জাতিক সভা সেমিনার ও অধিবেশনগুলোতে অন্যান্য ভাষা ব্যবহার হলেও আরবির কোনো স্থান ছিল না। তবে ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে জাতিঙ্ঘের সাধারণ সভার ২৮তম অধিবেশনে আরবি ভাষাকে এর দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ২০১২ সালে ইউনেস্কো সেই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস ঘোষণা করে।
পেছন ফিরে দেখা ইতিহাস
জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর দাফতরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। ইংরেজি, ফ্রান্স, চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ। আর বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষ ভূমিকা ও আরবি ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও আরব নেতাদের আরবি ভাষা ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। ভিনদেশী ভাষাতেই তাদের বক্তব্য প্রদান ও শ্রবণ করতে হতো। দাফতরিক কাগজপত্র আরবি থেকে অনুবাদ করে তা দাফতরিক ভাষায় উপস্থাপন করতে হতো। এ অবস্থা আরবদের জন্য ও বিশেষভাবে আরবি ভাষার জন্য ছিল লজ্জাজনক। তাই শুরু থেকেই আরব নেতারা এদিকটায় সজাগ ছিলেন। সর্বপ্রথম সৌদি আরব ও মরক্কো সরকার এ বিষয়ে কথা বলে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে ৪ ডিসেম্বর তাদের নবম অধিবেশনে ৮৭৮নং প্রস্তাবে আরবি ভাষায় লিখিত অনুবাদ প্রকাশের বৈধতা প্রদান করে। এবং বছরে চার হাজার পৃষ্ঠা অনুবাদের একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সাথে সাথে এ শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, অনুবাদের ব্যয়কৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশকে বহন করতে হবে এবং নথি ও কাগজপত্র আরব এলাকার রাজনৈতিক ও আইন বিষয়ক হতে হবে।
১৯৬০ সালে ইউনেস্কো আরব দেশগুলোতে আরবি ভাষায় সভা সেমিনার ও জাতীয় সম্মেলন পরিচালনা এবং তাদের নিজস্ব নথিপত্র ও প্রচারপত্র আরবিতে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সভাগুলোতে ভিন্ন ভাষা থেকে আরবি ভাষায় এবং আরবি ভাষা থেকে ভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯৬৮ সালে অনুবাদের সাথে সাথে আরবি ভাষাকে ইউনেস্কোর সাধারণ সভা ও কর্ম পরিষদের কার্যকরি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এই ধারাবাহিকতার সাথে সাথে আরব বিশ্বের কূটনৈতিক চাপ ও চেষ্টা অব্যাহত থাকে। এতে সৌদি ও মরক্কো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। শেষ পর্যন্ত তারা ১৯৭৩ সালে আরবি ভাষাকে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভার মৌখিক ভাষা হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাতে সমর্থ হয়। পরবর্তীকালে আরব লীগে তাদের ষাটতম অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, আরবিকে জাতিসঙ্ঘসহ তার অন্যান্য সংস্থাগুলোর দাফতরিক ভাষা করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালে জাতিসঙ্ঘের ২৮তম অধিবেশনে ৩১৯০ নং সিদ্ধান্তে আরবি ভাষাকে জাতিসঙ্ঘ ও তার সংশ্লিষ্ট সংস্থার দাফতরিক ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
২০১২ সালের অক্টোবরে ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদের বৈঠকের ১৯০তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস ঘোষণা করা হয় এবং এরপর থেকে সেই দিনটি ‘আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। আরবি ভাষা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সৌদিসহ অন্য আরব দেশগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
আমাদের করণীয়
এই লেখার মাধ্যমেই হয়তো অনেকে এ বিষয়টি জানবে যে, আরবি ভাষারও দিবস আছে এবং অন্যান্য দিবস পালনের মতো এটিও হয়তো দিবস পালনে উদ্বুদ্ধ করার কোনো প্রয়াস। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে চাই, এই লেখা সে ধরণের কোনো উদ্দেশে প্রচার বা প্রসারের নিমিত্তে নয়; বরং এটি একটি তথ্য- যা আরব বিশ্বসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরবি ভাষাকে নিয়ে প্রচলিত, তা সবার গোচর করা। আর আমরা যেহেতু কুরআনের এই ভাষাকে ভালোবাসি- তাই এ বিষয়ে একটু নতুন করে ভাবা। অথবা বলা যায় আরবি শেখার ক্ষেত্রে ‘তাজদীদুন নিয়্যাহ’ বা নিয়তের নবায়ন করা। এছাড়াও যে বিষয়গুলো আমাদের করণীয়, তা হচ্ছে-
১. আরবি ভাষার খেদমতে সকলকে আত্মনিয়োগ করা এবং এক্ষেত্রে সকল প্রকার চেষ্টা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
২. জনসাধারণের হৃদয়ে আরবি ভাষার প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা।
৩. সবার মধ্যে আরবি ভাষা শেখার গুরুত্ব তুলে ধরা। এবং আরবি শেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা।
৪. আরবি শিক্ষার্থীদের আরবি ভাষায় কথা বলায় অভ্যস্ত করা, আরবি ভাষায় লেখালেখি করার সুযোগ প্রদান করা।
৫. আরবিকে শুধু কুরআন-সুন্নাহ বোঝার জন্য না পড়ে জীবন্ত ও ব্যবহারিক ভাষা হিসেবেও শেখা।
উপরোক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে কিছু প্রস্তাবনা-
১. সঠিকভাবে ভাষা শিক্ষা দিতে হলে ভাষা ও বিষয়ের সুসমন্বয় থাকা প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক) ও সরকারি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের এ বিষয়ে নজর দেয়া দরকার।
২. আরবি ভাষা শিক্ষাদানে ভাষাবিজ্ঞাননির্ভর ও সুনির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে বোর্ড কর্তৃক পুস্তক প্রণয়ন করা এবং প্রত্যেকেই নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘ছাহেবে মানহাজ’ না হয়ে আরবি ভাষায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ এমন ভাষাবিদ ও আদিবদের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ মানহাজ বা সিলেবাস প্রণয়ন করা।
৩. ভাষাগত চারটি দক্ষতা (বলা, লেখা, পড়া এবং শোনা) পূরণে বর্তমানে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের দিক বিবেচনা করে একটি সুসমন্বিত পাঠ-উপকরণ তৈরি করা বেফাক ও সরকারি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবশ্যকরণীয় কাজ।
৪. সহজে শিক্ষার্থীদের আরবি ভাষায় পারদর্শী করে তুলতে ‘পরিকল্পিত আরবি ভাষা পরিবেশ’ সৃষ্টির করা।
৫. আরবি ভাষা বিষয়ে পাঠদান হতে হবে আরবিতে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সার্বক্ষণিক আরবি ভাষা চর্চার সুযোগ পাবে।
৬. লেখালেখির সাথে অভ্যস্ত করতে দেয়ালিকা, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশ করা ।
৭. আরবি ভাষা শিক্ষাদানে নাহু-ছরফের (শব্দ গঠন শৈলী ও বাক্য গঠন শৈলী) মতো কথোপকথন ও ভাষাচর্চার কোর্স বা দাওরার ব্যবস্থা করা ।
৮. শিক্ষাঙ্গনে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে আরবি পরিভাষা ব্যবহার করা।
৯. আরবি ভাষা শেখাবেন যে সকল শিক্ষক তাদের জন্য অভিজ্ঞ আরবি ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষাবিদদের মাধ্যমে ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স’ আয়োজন করা।
১০. আরবি ভাষাকে নিয়ে আরবিতে সভা সেমিনার ও অনুষ্ঠান আয়োজন করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কুরানের ভাষার খেদমতে কাজ করার তাওফিক দান করুন। সঠিক ও সুন্দরভাবে আরবি ভাষা শেখার তাওফিক দান করুন। এই ভাষার জন্য আমাদের সবধরনের প্রচেষ্ঠাকে আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমিন।
লেখক : তরুণ ভাষাবিদ ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক-মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ