১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

শিশুর কৃমির সমস্যায় করণীয়

শিশুর কৃমির সমস্যায় করণীয় -


বিভিন্ন তিতা খাবার বা সবজির কৃমিনাশক ভেষজগুণ আছে। তবে এরা কেউ কৃমি আশানুরূপ নির্মূল করতে পারে না। তাই কৃমিনাশক ওষুধ লাগে

কৃমি একটি ক্ষতিকর পরজীবী যা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে পুষ্টি গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। আমাদের অন্ত্রে কোটি কোটি উপকারি ব্যাকটেরিয়া থাকে, কিন্তু এই কৃমি ক্ষতি ছাড়া কিছুই করে না। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার- এরা অন্ত্র থেকে প্রায়ই রক্তের মাধ্যমে যকৃত, ফুসফুস এমনকি মস্তিষ্কে চলে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
আকৃতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন কৃমি আলাদা করা যায়। গুঁড়া বা সূতা (এন্টারোবায়াস), গোল (এসক্যারিস), সূচ (এঙ্কাইলোস্টোমা, নেক্যাটার), চাবুক (ট্রাইচুরিস), ফিতা (সিস্টোড গোত্র), পাতা (ট্রেমাটোড গোত্র), অনেক আকৃতিতেই এদের পাওয়া যায়। এদের অধিকাংশ শরীরে প্রবেশ করে খাবারের মাধ্যমে (দূষিত খাবার, পানি, হাত, অসম্পূর্ণ সেদ্ধ মাছ, গোশত), তবে কিছু কৃমি চামড়া ভেদ করে (সূচ) আর কিছু শ্বাসের মাধ্যমেও প্রবেশ করে।
কৃমি কয়েকভাবে আমাদের ক্ষতি করে। অন্ত্রে ঘা করে নিজেরাও রক্ত খায় আবার ঘা থেকে রক্ত চুইয়ে পড়তে পারে। আবার বিভিন্ন পুষ্টি কনিকা, ভিটামিন (বি-১২, ফলিক এসিড) শোষণ করে রক্তাল্পতা বাড়িয়ে তুলে। আক্রান্ত শিশু আমাদের কাছে আসে খাদ্যে রুচির অভাব, খিটখিটে, রক্তাল্পতার লক্ষণ, অপুষ্টির লক্ষণ, পায়খানার রাস্তায় চুলকানি, প্রায়ই বমি বমি ভাব বা মাঝে মধ্যে পাতলা পায়খানা নিয়ে। মা এসে বলে শিশু লম্বায়, বা ওজনে বাড়ছে না। আবার বিপুল কৃমি দলা পাকিয়ে অন্ত্র, অ্যাপেন্ডিক্স আঁটকে দিয়ে অন্ত্রে প্রতিবন্ধকতা করে। ফলে শল্যচিকিৎসা পর্যন্ত লাগে। জকৃতে, মস্তিষ্কে ফোঁড়া বা মোল করে জীবনাশঙ্কা করতে দেখা যায়। আরেক ধরনের কৃমি ফুসফুসে ঢুকে নিউমোনিয়া ঘটাতে পারে।

রোগী কোনো ধরনের কৃমি দিয়ে আক্রান্ত, কোনো ওষুধ কার্যকর হবে- এটি নির্ণয় করতে পায়খানা বা পায়খানার রাস্তার রস পরীক্ষা করে কৃমির ডিম, লার্ভা কিংবা আস্ত কৃমি বের করতে হয়। তীব্র অপুষ্টি বা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত শিশুর রক্ত পরীক্ষা করে রক্তাল্পতার ধরন বের করাও জরুরি।
কৃমির চিকিৎসায় বিভিন্ন মুখে খাওয়ার ওষুধ পাওয়া যায়। অ্যালবেনডাজোল, ম্যাবেনডাজোল, পাইরেন্টাল পামোয়েট, লেভামিসোল জাতীয় ওষুধগুলো আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি। শিশুদের ক্ষেত্রে কৃমির ধরন, ওজন, আগের ইতিহাসের উপর নির্ভর করে সঠিক ওষুধ ও ডোজ ঠিক করতে হয়। সাধারণত ভরা পেটে কৃমির সেবন করতে হয়। যদিও ফিতা কৃমি হলে, যার উৎস অসম্পূর্ণ সেদ্ধ বা কাঁচা মাছ, গোশত, পরপর তিন দিন খালি পেটে অ্যালবেনডাজোল সেবন করতে হয়। বারবিকিউ কালচার, বিভিন্ন ফাস্টফুডের জন্য এই কৃমি বেড়েই চলেছে।
তবে সব রোগের মতো এখানেও প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি কিছু সাধারণ প্রচলিত ধারণা নিয়েও কিছু বলা দরকার। লেখাটি শেষ করব এমনই কিছু সচেতনতামূলক তথ্য দিয়ে।

১. খাওয়ার আগে, টয়লেট থেকে বের হয়ে, মায়ের শিশুকে শুচি করার পর সাবান দিয়ে অবশ্যই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মেয়ে শিশুদের শুচির সময় পায়খানার রাস্তা সামনে থেকে পেছন দিকে টান দিতে হবে। আঁটসাঁট প্যান্ট, আন্ডারপ্যান্ট পরানো অনুচিত।
২. হাতের নখ নিয়মিত কেটে ছোট রাখতে হবে। নেইলপলিশ দেয়ার জন্য লম্বা করে রাখা নখ কৃমি ডিমের নিরাপদ স্থল।
৩. শিশু যাতে সরাসরি নখ দিয়ে পায়খানার রাস্তা না চুলকায়। চুলকালে কৃমির ডিম বা অন্য অংশ নখের মাধ্যমে মুখ হয়ে আবার অন্ত্রে ঢুকে যায়। ফলে এক অপরিচ্ছন্ন চক্র চলতে থাকে।
৪. বাইরে থেকে আনা ফল ধুয়ে খেতে হবে। টেবিলের খাবার ঢেকে রাখতে হবে। ফোটানো বা ফিল্টার করা বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
৫. টয়লেটে বা মাটিতে খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। টয়লেটে ব্যবহারের স্যান্ডেল প্রতিদিন পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখবেন।
৬. স্কুলপড়ুয়া শিশুরা অবশ্যই সরকারি নিয়মমতো কৃমির ওষুধ খাবে। অন্য শিশুদেরও বছরে তিনবার কৃমির ওষুধ খাওয়া উচিত। ছোটরা কৃমির ওষুধ খেলে একই সাথে পরিবারের বড়দেরও খেতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। তবে সচেতন পরিবারের সবাই সময় মনে রাখার জন্য একসাথে খেলে ভালো। কৃমির ওষুধের পর ভিটামিন ওষুধ খেতে হবে এমন কথা নেই। তবে চিকিৎসক লৌহ বা অন্যান্য ভিটামিনের অভাব দেখলে সেই ওষুধ দিতে পারেন।
৭. গরমের দিনে কৃমির ওষুধ খেলে কোনো সমস্যা নেই। তবে যেকোনো সময় কৃমির ওষুধ খেলে বমি ভাব, বমি, পেট ব্যথা হতে পারে। অন্ত্রে আগে থেকে বিপুল পরিমাণ বাসা বেঁধে থাকা কৃমি মরে গিয়ে অন্ত্রনালী প্যাঁচিয়ে বন্ধ করে দিতে পারে। এটি খুব বিপজ্জনক অবস্থা। তাই কৃমির অসুথ সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় খাওয়া উচিত। আমাদের দেশে ‘মাস প্যানিক অ্যাটাক’ একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা। কুসংস্কার, ভুল ধারণার বশবর্তী লোকজন (বিশেষ করে স্কুলের শিশুরা) একজনকে অসুস্থ হতে দেখলে গণহারে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারটি সম্বন্ধে জনসচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
৮. বিভিন্ন তিতা খাবার বা সবজির কৃমিনাশক ভেষজগুণ আছে। তবে এরা কেও কৃমি আশানুরূপ নির্মূল করতে পারে না। তাই কৃমিনাশক ওষুধ লাগে।
৯. চিনি, গুঁড়, মিছরি, মিষ্টি খাবারের সাথে কৃমি সংক্রমণের সম্পর্ক নেই; বরং হালের বারবিকিউ, রেস্টুরেন্টের বাসি সস, পিজ্জা, বার্গার, হটডগ প্রভৃতি খাবারে কৃমির অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে।
লেখক : রেজিস্ট্রার, আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা

 

 


আরো সংবাদ



premium cement