খাবারের সাথে জড়িয়ে থাকা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করবেন যেভাবে
- রাশিদুল ইসলাম
- ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৪৭
আপনার পছন্দের তালিকায় যে খাবার আছে তা গ্রহণে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তাহলেই সর্বনাশ, এমন পরামর্শ প্রায়ই দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। তবে খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
আবেগপূর্ণ খাওয়া সবসময় এত খারাপ নয়। তবে আপনার পছন্দের চকোলেট, চিপ কুকিজগুলো কিংবা অন্য যেকোনো খাবার খেতে একটু রয়ে সয়ে নিতে হয় এই যা।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের রকভিলে দ্য ইটিং ডিসঅর্ডার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা জেনিফার রোলিন বলেছেন, আবেগ যখন আপনাকে খাবার খেতে আপনার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তখন তা সংবেদনশীল খাওয়া হিসাবে পরিচিত, যা প্রায়ই ভীতিকর, অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। কিন্তু যেকোনো খাবারের সঙ্গেই একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের অংশ জড়িয়ে আছে তা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
তাই খাবার যখন আপনার কাছে আবেগপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে তখন তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে চিকিৎসকের কঠোর নিয়ম এবং আপনার বিরুদ্ধে স্বজনদের লজ্জা-ভিত্তিক কৌশল প্রয়োগ যাতে আপনি ওই খাবার নিয়ে আবেগের পরিবর্তে বিবেক খাটাতে বাধ্য হন। পেনসিলভানিয়ার ডিসঅর্ডার ডায়েটিশিয়ান ডেইজি মিলার তাই বলছেন, আবেগপূর্ণ খাওয়াকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাখার এবং খাবারের সাথে স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের জন্য এর বিরুদ্ধে না গিয়ে কীভাবে মেনে বেছে চলতে হয় তা শিখতে হবে।
আবেগপূর্ণ খাওয়া কী?
জেনিফার রোলিন বলেন, খাদ্য সহজাতভাবে আবেগপ্রবণ। আপনি সম্ভবত একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে নির্দিষ্ট খাবারের কথা ভাবতে পারেন, এভাবে খাবারটি আপনার সাথে সামাজিকভাবে সংযোগ স্থাপন করে। যেমন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিয়ে বাড়িতে কাচ্চি, বিরিয়ানি, কালো ভুনা এমন সব নানা পদের রিচ ফুডের তালিকা চোখের সামনে ভেসে আসে। মিলার বলেন, কার্যত যখন খাবার সম্পর্কে আমরা চিন্তা করি তখন আমরা দেখতে পাই আমাদের জীবন খাদ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। খাবার সত্যিই সান্ত¡নাদায়ক হতে পারে, এবং আমরা অনেকেই আমাদের সমস্ত সংস্কৃতিতে এমন খাবারের চারপাশে ঐতিহ্য তৈরি করে যা নস্টালজিক এবং অনুভূতিপ্রবণ।
মানুষের দেহগুলোও খাদ্য উপভোগ করার জন্য তৈরি করা হয়, তাই এটি বোঝায় যে আপনি যখন শক্তিশালী আবেগ অনুভব করছেন, তখন আপনি এমন কিছু খাদ্য গ্রহণের সিদ্ধান্তে পৌঁছান যা স্বাদ বা খেতে ভাল বোধ করেন। যদি আপনি উপভোগ করেন এমন কিছু খাওয়া যা খাবারের ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণের জন্যে পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হয় তাহলে আপনার নিজেকে নিজের কাছে লজ্জিত করা উচিত নয়। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলেন, কখনো কখনো আবেগজনিত কারণে, কেবল একটি খাবার খাওয়া কোনও সমস্যা নয় এবং এমন কিছু নয় যার জন্য আপনাকে বিচার করতে হবে বা নিজেকে তা থেকে দূরে থেকে নিজের বাসনাকে গলা টিপে মারতে হবে।
আপনি কি একটি কঠিন দিন বা একটি মাইলফলক উদযাপনের পরে সুস্বাদু কিছু উপভোগ করার জন্য খাচ্ছেন? অথবা আপনি একটি বড় সমস্যা এড়াচ্ছেন? খাবার তো খাবার কারো জীবনে কী ঘটছে তার বড় চিত্র না জেনে আমরা কখনই বলতে পারি না এটি সম্পূর্ণ ভাল বা এটি সম্পূর্ণ খারাপ।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, আমাদের কেবল খাবার ওপর থেকে আবেগকে দূরে সরিয়ে দেওয়া উচিত নয় এবং আমাদের শরীরকে চালু রাখার জন্য এটিকে কেবল জ্বালানী বা শক্তি হিসাবে ভাবা উচিত নয়। এমন ধারণা যে সবসময় কাজ করবে তা নয়। রোলিন বলেন, হ্যাঁ, খাদ্য হল জ্বালানী যা আপনার মস্তিষ্ক এবং দেহের জন্য শক্তি সরবরাহ করে, তবে এটি তার থেকেও অনেক বেশি।
রোলিন বলেন, কখনো কখনো, যখন লোকেরা শুধুমাত্র সবচেয়ে পুষ্টিকর ঘন খাবার খাওয়ার মধ্যে খুব বেশি জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা আনন্দ, খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সামাজিকতা এবং সামাজিক সংযোগের জন্য খাবার জড়িত এমন অনেক মুহূর্ত মিস করে। যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয় যে খাবারটি কেবল জ্বালানি, তবে মনে হয় যখন আমি ক্ষুধার্ত না তখন বন্ধুর সাথে মিষ্টান্নের জন্য বাইরে যাওয়া হয়ত 'স্বাস্থ্যকর বিকল্প' নয়, তবে, আমরা এও জানি যে প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক সম্পর্কগুলি স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ুর সবচেয়ে বড় ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে একটি।
নর্থ ক্যারোলিনার শার্লটের একজন নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান নাটালি মোকারি বলেছেন, আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল যে অত্যধিক বিধিনিষেধ প্রায়শই দ্বিধাহীন খাবারের পিছনে প্রভাব ফেলতে পারে। খাবার নিয়ে অযথা আমার এটি খাওয়া একদম উচিত নয়, তবে আমি এটি কি করতে যাচ্ছি এবং আমি এটি অতিরিক্তভাবে করতে যাচ্ছি, কারণ আমি এটি আর কখনও খাব না, এই ধরনের ভাবনা আপনাকে খাবার নিয়ে আনন্দের পরিবর্তে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেবে।
দ্বিধাগ্রস্ত খাওয়ার বিষয়ে কখন চিন্তা করবেন
পছন্দের খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি সীমা রেখা আছে, তবে, যখন আবেগপূর্ণ খাওয়া একটি সমস্যা হয়ে ওঠে, এবং এটি প্রায়ই ঘটে তখন এধরনের সীমা রেখা নিয়ে আপনি ভাবতেই পারেন। বরং কঠিন আবেগের সাথে মোকাবিলা করার জন্য আপনি কত ঘন ঘন খাচ্ছেন এবং সেই আবেগগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আপনার কাছে অন্যান্য কৌশল বা বিকল্প খাবার রয়েছে কি না তাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু সতর্কীকরণ লক্ষণ যে আপনি খাবারের উপর খুব বেশি নির্ভর করছেন এবং এভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় তা মোকাবেলা করতে যেয়ে দ্বিধা ভোজনে জড়িত হচ্ছেন, অল্প সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ লোকের চেয়ে বেশি পরিমাণে খাওয়া, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা, অপরাধবোধ এবং লজ্জা বোধ করা, গোপনে খাওয়া এবং প্রায়শই খাওয়া এক সময়ে আপনাকে সীমা রেখার বাইরে নিয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। আপনি যদি খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার চেয়ে বেশি খান এবং তারপরে আপনি এ নিয়ে ঝুঁকি এড়াতে বাধ্যতামূলক ব্যায়ামে নিযুক্ত হতে বাধ্য হন তখন আরেকটি লক্ষণ হবে যে খাবারের সাথে আপনার সম্পর্ক সমস্যাযুক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে তা টেরই পাননি।
খাদ্যের সাথে একটি স্বাস্থ্যকর নমনীয় সম্পর্ক এবং ভারসাম্যের চারপাশে আপনার অবস্থান নিরাপদ। নিয়ন্ত্রণের বাইরে বোধ না করে আপনি কি নিজেকে সব ধরণের খাবার খাওয়ার অনুমতি দিতে পারেন?
সংবেদনশীল খাওয়ার সাথে একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হলো মননশীলতা। চিন্তা না করে খাবারের জন্য সীমাবদ্ধ বা পৌঁছানোর পরিবর্তে, খাবারটি কী উদ্দেশ্যে পরিবেশন করা হচ্ছে এবং এর জন্য কী প্রয়োজন তা সম্পর্কে সচেতন হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?
হয়তো আপনি একঘেয়েমি বা মানসিক চাপ মোকাবেলা করছেন। হতে পারে আপনি একটি পারিবারিক প্রথার সাথে জড়িত হতে চান বা জন্মদিনের কেক দিয়ে একটি উপলক্ষ চিহ্নিত করতে চান। তাহলে এর
চাবিকাঠি হলো আপনার মূল্যবোধ, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি এবং খাদ্যের সাথে আপনার সম্পর্ককে বিচারের পরিবর্তে কৌতূহলের সাথে মূল্যায়ন করা। মিলার বলেন, লোকেরা 'খাদ্য নিয়ে প্রায় ভাবতে পারে যে তারা নিজের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহকারী গোয়েন্দা।' এটা কি এমন কিছু যা সমস্যা হয়ে উঠছে? এটা কি এমন কিছু যা আমি শুধুমাত্র খাবারের মাধ্যমে মোকাবেলা করছি? এখানে কি আরও গভীর স্তর রয়েছে যা নিয়ে কাজ করা দরকার?
এবং আপনি নিজেকে খাওয়ার অনুমতি দেয়ার সাথে লড়াই করছেন বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে খাওয়ার সাথে লড়াই করছেন, এটি একজন থেরাপিস্ট বা ডায়েটিশিয়ানের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া সহায়ক হতে পারে যা বিশৃঙ্খল খাওয়া, ওজন অন্তর্ভুক্ত এবং অ্যান্টি-ডায়েট ক্ষেত্রগুলিতে কাজ করে। মিলার এও বলেন, আপনি সঠিক ধরণের পেশাদারের কাছে যাচ্ছেন তা নিশ্চিত করা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ যাতে আপনি খাবার নিয়ে কিছু অনুভূতি প্রক্রিয়ায় যেতে পারেন যা আপনি অনুভব করছেন এবং লজ্জা বা অপরাধবোধ অনুভব করবেন না বা আপনি খারাপ বা ভুল কিছু করছেন, এমন কখনই ভাববেন না।
সূত্র : সিএনএন