০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

সর্পদংশনের প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ভেনম রিসার্চ সেন্টার, মেডিসিন বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ
-

ভূমিকা : সর্পদংশন একটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ও একটি জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই সর্পদংশন হয়ে থাকে। সর্পদংশিত ব্যক্তি এ রকম পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত থাকেন না। বিষধর সাপের দংশনের পর মৃত্যু হতে পারে। সর্পদংশন ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান।
সর্পদংশনের জরুরি প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে সাধারণ নিয়মাবলি
রোগীকে আশ্বস্তকরণ : ‘অনুগ্রহপূর্বক ভয় পাবেন না’। বেশির ভাগ সাপ অবিষধর। ভয়ের কোনো কারণ নেই, সর্পদংশনের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে।
অচল রাখা : নিশ্চিত করুন যে, দংশিত অঙ্গ (হাত কিংবা পা) অচল করা হয়েছে এবং দংশিত ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্রামে আছে।
পায়ে দংশনে : বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশনে হাত নাড়াচাড়া করা যাবে না।
খুলে ফেলা : যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দংশিত অঙ্গ থেকে আংটি, চুড়ি, তাবিজ, তাগা খুলে ফেলতে হবে। দংশিত অঙ্গ ফুলে গেলে পরবর্তীতে এগুলো খুলতে অসুবিধা হবে।
দংশিত অঙ্গ হাড় ভেঙে গেলে যেভাবে স্প্রিন্টের সাহায্যে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয় তেমনিভাবে রাখতে হবে। হাতের কাছে যদি ক্রেপ ব্যান্ডেজ থাকে তাহলে তাই ব্যবহার করতে হবে। দংশনকৃত হাত-পা এমনভাবে কাপড় ও কাঠ (বা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে, যাতে গিড়া নড়াচড়া করা না যায়। গিড়া নাড়াচড়ায় মাংসপেশির সঙ্কোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
দংশিত স্থান নিষ্ক্রিয় করার জন্য আদর্শ পদ্ধতিতে চাপ প্রদান করতে হবে। (Pressure Immobilization) ।
দংশিত স্থানে রক্তক্ষরণ হতে থাকলে চাপ দিয়ে ধরে রাখা।
দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণ : দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার জন্য মোটরবাইক/গাড়ি/অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্য নিন।
রোগীকে একপাশে কাত করে রাখতে হবে।
যদি শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকে, তাহলে মুখে বায়ু ঢোকার নল (Oral Airway) ব্যবহার করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হবে।
কেউ যদি সাপ মেরে থাকেন, হাসপাতালে যাওয়ার সময় শনাক্তকরণের জন্য তা নিয়ে যেতে হবে। সাপ মারার জন্য কিংবা ধরার জন্য অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না। সাবধান, খালি হাতে সাপ ধরতে যাবেন না।
বিষধর সর্পদংশনের লক্ষণসমূহ : * দংশিত স্থান দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোস্কা পড়া, চামড়ার রঙ পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, পচে যাওয়া, ক্রমাগত রক্তপাত। একেবারে কোনো প্রভাব না থাকা * ঘুম ঘুম ভাব * চোখের উপরের পাতা ভারী হওয়া বা বুজে আসা * চক্ষুগোলক নড়াচড়া করতে না পারা * ঝাপসা দেখা বা একটি জিনিসকে দুটো দেখা * জিহ্বা জড়িয়ে আসা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া * ঢোক গিলতে অসুবিধা, খাওয়ার সময় নাক দিয়ে পানি আসা * হাঁটতে অসুবিধা হওয়া, হাত-পা অবস হয়ে যাওয়া * ঘাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া * শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা হয়ে রোগী নীল বর্ণ হয়ে যাওয়া * কাল রঙের প্রস্রাব হওয়া * প্রস্রাব কমে যাওয়া।
এই সব ক্ষেত্রে রোগীকে অত্যন্ত দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সর্পদংশনের পর যা করা উচিত নয় : * দংশিত অঙ্গে কোনো রকম গিঁট (tourniquets) দেয়া যাবে না। * দংশিত স্থানে কাটবেন না, সুই ফুটাবেন না, কিংবা কোনো রকম প্রলেপ লাগাবেন না। * ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করে কিংবা ঝাড়-ফুঁক করে অযথা সময়ক্ষেপণ করবেন না। * হাসপাতালে নেয়ার পথে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, নাকে কথা বললে কিংবা মুখ থেকে লালা ঝরলে রোগীকে কিছু খেতে দেবেন না। * দংশিত স্থানে রাসায়নিক পদার্থ, অ্যালকোহল জাতীয় কিছু দেয়া যাবে না; কোনোভাবেই- হারবাল ওষুধ, পাথর, বীজ, মুখের লালা, পটাশিয়াম, কাদা, গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। * তেল, ঘি, মরিচ, গাছ-গাছালির রস ইত্যাদি খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না। * ব্যথা উপশম করার জন্য অ্যাসপিরিন দেয়া যাবে না। * স্বাস্থ্য সুবিধা নিতে হাসপাতালে পৌঁছাতে বিলম্ব করবেন না।
সর্পদংশন প্রতিরোধ/সর্পদংশন কিভাবে এড়ানো যায়?
১. বসতবাড়ির শোয়ার ঘরের সাথে খাবার যেমন- ধান-চাল, হাঁস-মুরগি, কবুতর না রাখা উত্তম। এসব ইঁদুরকে আকর্ষণ করে যার খোঁজে সাপ ঢুকতে পারে।
২. ঘাসের মধ্যে কিংবা ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর আপনাকে যদি হাঁটতে হয় তাহলে খুব সাবধানে হাঁটুন ও লম্বা জুতা কিংবা বুট জুতা পরুন। গর্তের মধ্যে হাত-পা ঢুকাবেন না।
৩. স্তূপকৃত লাকড়ি বা খড় সাবধানে সরান। বড় বড় পাথর বা কাঠের গুঁড়ি সাবধানে সরানো উচিত।
৪. মাছ ধরার সময় ‘চাঁই’ বা জালের মধ্যে হাত দেয়ার আগে সাপ আছে কি না দেখে নিন।
৫. বেশির ভাগ সাপ রাতে সক্রিয় থাকে, রাতে হাঁটার সময় কিংবা প্রাকৃতিক কাজে টর্চলাইট ও লাঠিসহ বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।
৬. ঘুমের সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন : খাটের ওপর ঘুমাবেন, মেঝেতে ঘুমাবেন না। ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন। রাতের বেলায় শস্য, ফলের বাগান কিংবা মাছ পাহারা দেয়ার সময় মাটিতে কিংবা মাচায় ঘুমানোর বা শোয়ার ব্যাপারে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।
৭. বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখুন। বাড়ির আঙ্গিনা ময়লা-আবর্জনামুক্ত রাখুন। বাড়ি ও চাষ করার জমির মধ্যে দূরত্ব রাখুন।
- সাপ ছদ্মবেশী শিকারি, অর্থাৎ তারা শিকারকে লুকানোর জায়গা থেকে আক্রমণ করে।
- ময়লা-আবর্জনা সাপ লুকানোর জন্য উপযুক্ত স্থান। পাতা, সার, খড়ের গাদা, লাকড়ির স্তূপ, কাটা ঘাসের স্তূপ সাপের জন্য লুকিয়ে থাকার পছন্দনীয় স্থান। কাজেই এগুলো বাড়ির আঙ্গিনা থেকে সরিয়ে নিন।
৮. বাড়িকে সাপের সম্ভাব্য খাবারমুক্ত রাখুন। প্রজাতি ভেদে ইঁদুর, ছোট প্রাণী, তেলাপোকা, ঘাসফড়িং সাপের প্রিয় খাবার।
৯. সাপ বসতবাড়ির গর্তে বা ফাটলে লুকিয়ে থাকতে পারে বিধায় এগুলো মেরামত করুন।
১০. ঘরে প্রবেশের আগে লাইটের সুইচ অন করুন।
১১. বিছানা, বালিশের নিচ ও স্কুলব্যাগ যতœসহকারে দেখুন। শব্দ করুন যাতে লুকিয়ে থাকা সাপ সরে যেতে পারে। জোরে পায়ের শব্দ করে আপনার উপস্থিতি সম্বন্ধে সাপকে সতর্ক করুন। সাপ বায়বীয় শব্দের প্রতি অপেক্ষাকৃত বধির তবে ভূগর্ভস্থ কম্পনের প্রতি সংবেদনশীল।
১২. উইয়ের ঢিবিতে, গাছের গর্তে, স্তূপকৃত গাছ-তক্তা, লাকড়ির মধ্যে এবং ঘন আগাছার মধ্যে হাত দেবেন না। কাস্তে দিয়ে পাকা ধান কাটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। মানুষের বাসস্থানের চারপাশে সাপ থাকার সম্ভাব্য জায়গা পরিষ্কার রাখুন। উইয়ের ঢিবি পরিষ্কার করুন, গাছের গর্ত ভরাট করুন। পতিত গাছ, লগ, জ্বালানি লাকড়ি সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করুন।
১৩. কেবল প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরই সাপ নাড়াচাড়া করা উচিত। সাবধান! খালি হাতে সাপ ধরবেন না, কারণ সাপ মরার ভান করতে পারে।
১৪. বাংলাদেশের বিষধর সাপ ও তাদের বাসস্থান সম্বন্ধে জানুন, যাতে আপনি তাদের এড়িয়ে যেতে পারেন।
সাপ দেখলে আপনি কী করবেন : ষ অযথা ভয় পাবেন না, সাপটিকে চলে যেতে দিন ষ সাপ স্বেচ্ছায় মানুষকে দংশন করে না সুযোগ দিলে সাপ সরে যাবে। কেবল আত্মরক্ষায় কিংবা উত্ত্যক্ত করলে সাপ মানুষকে দংশন করে; কাজেই সাপের কাছে না ঘেঁষা বাঞ্ছনীয় ষ অনাবশ্যক সাপ মারবেন না, কারণ সাপ কীটপতঙ্গ ও ছোট ছোট প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষের উপকার করে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ।
বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাপসমূহ : স্থলজ প্রায় ৮৩ প্রজাতি, যার ১১ ধরনের সাপ বিষধর : ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ বিষধর। রাজ গোখরা (King Cobra), পদ্ম গোখরা (Monocellate Cobra), খৈয়া গোখরা (Binocellate Cobra), শঙ্খিনী (Banded Krait), বড় কাল কেউটে (Greater Black Krait), ছোট কাল কেউটে (Lesser Black Krait), শাখামুঠী/কালাচ (Common Krait), ওয়ালস ক্রেইট (Wall's Krait), চন্দ্রবোড়া (Russell's Viper), সবুজবোড়া/গালটাউয়া (White- lipped Green Pit Viper), সবুজবোড়া/গালটাউয়া (Red-tailed Bamboo Pit Viper)।


আরো সংবাদ



premium cement
ইফার দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত ঢাকা ওয়াসার কেউ দুর্নীতিতে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা : উপদেষ্টা আসিফ ২২ ফেব্রুয়ারি হাবের নির্বাচন রাজধানীতে পৃথক ঘটনায় কুপিয়ে ও শ্বাসরোধে ২ জনকে হত্যা ৪২ লাখ টাকাসহ প্রতারক চক্রের সদস্য গ্রেফতার ডিএমপি কমিশনারের সাথে য্ক্তুরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ তারুণ্যের উৎসবে স্থান পাচ্ছে জুলাই আগস্টের তথ্যচিত্র মৃত্যুবার্ষিকী : রফিকুল ইসলাম আধুনিক অটোমোবাইলস জোন প্রতিষ্ঠার দাবি ওয়েলফেয়ার অব ড্রাইভারস্ এন্ড মেকানিক্সের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননার অভিযোগ, আটক ৩ ১০ লাখ টাকার অনুদানের চেক শহীদ আবু সাঈদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর

সকল