কোলন ক্যান্সারসহ আরো যেসব রোগ মুখে থাকা ব্যাকটেরিয়ার সাথে সম্পর্কিত
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০১ জুন ২০২৪, ১৭:২১, আপডেট: ০১ জুন ২০২৪, ১৭:২৫
মুখ হলো মানবদেহের অন্যতম এক বিচিত্র জায়গা, যেখানে সাত শ’র বেশি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস এবং কিছু প্রোটোজোয়ার বসবাস। এই সবগুলো একসাথে ওরাল মাইক্রোবায়োম নামে পরিচিত। অন্ত্রে থাকা মাইক্রোবায়োমের মতো মুখে থাকা ব্যাকটেরিয়াও মানুষের শরীরের সুস্থতা বা অসুস্থতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ওরাল মাইক্রোবায়োমে পরিবর্তনের কারণে খুব সাধারণ কিছু রোগ হয়। যেমন- ক্যাভিটিস এবং গাম ডিজিজ। দাঁতের শক্ত জায়গায় ছোট গর্ত হওয়াকেই ক্যাভিটি বলে, সাধারণভাবে যেটি দাঁতে পোকাধরা নামেও পরিচিত। আর, গাম ডিজিজ বা মাড়ির রোগকে ডাক্তারি ভাষায় পেরিওডনটাইটিস বলে।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে ওরাল মাইক্রোবায়োম শুধু দাঁত বা মুখের ওইসব সাধারণ রোগগুলোর কারণ না। এটি শরীরের অন্যান্য অনেক রোগের সাথেও সম্পর্কিত।
১. শ্বাসতন্ত্রের রোগ
যেহেতু শ্বাসনালী শুরুই হয় মুখ থেকে এবং শেষ হয় গিয়ে ফুসফুসে, সেক্ষেত্রে এটি সম্ভবত খুব বেশি আশ্চর্যজনক নয় যে ওরাল মাইক্রোবায়োমের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে জীবাণুগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করবে।
এতে করে খুব সহজেই নিউমোনিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। এটি সাধারণত বয়স্কদের মাঝে বেশি হয়, যার সাথে মুখের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত। মৌখিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটে।
এমনকি, গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত ওরাল হাইজিন বা মৌখিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং পেশাদার দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়ে দাঁত পরিষ্কার করানো হলে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বাঁধানো দাঁত ও মাউথ গার্ড পরিষ্কার থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
মুখ পরিচ্ছন্ন না থাকলে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ হতে পারে। এই সবই ওরাল মাইক্রোবায়োমের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত।
২. হৃদরোগ
ওরাল মাইক্রোবায়োম থেকে সৃষ্ট খুব সাধারণ রোগগুলোর একটি হলো ক্রোনিক পেরিওডনটাইটিস।
এই রোগ মূলত মাড়ির সংক্রমণ। এর ফলে মাড়িতে প্রদাহ হয় এবং একসময় মাড়ির হাড় ও টিস্যুগুলোকে নষ্ট করে। এভাবেই দাঁতের চূড়ান্ত ক্ষতি হয়।
মুখ যদি অপরিচ্ছন্ন থাকে, তাহলে মাড়ি ও দাঁতের মধ্যবর্তী স্থানে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়।
একটি বিষয় গবেষকদের বছরের পর বছর ধরে বিভ্রান্ত করেছে। তা হলো- গাম ডিজিজ (জিনজিভাইটিস ও পেরিওডনটাইটিস) বা মাড়ির রোগের সাথে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজের সম্পর্ক।
যেমন- মাড়ির রোগ ও হৃদরোগ, উভয় রোগই ধূমপায়ীদের মাঝে বেশি দেখা যায়।
অনেকে বলছেন যে মাড়ির রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া হৃৎপিণ্ডে গিয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
তবে এই দাবির স্বপক্ষে এখনো কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি তারা।
মাড়ির রোগ হলে এটি মাড়িতে প্রদাহজনক (ব্যথা, ফোলা, জ্বালাপোড়া) অবস্থা সৃষ্টি করে। আঘাত, সংক্রমণ বা অসুস্থতা প্রকাশ করার জন্য ইমিউন সিস্টেমের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো প্রদাহ।
প্রদাহ হলে শরীরে ইমিউন সেল ও কেমিক্যাল সিগন্যাল তৈরি হয়, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
কিন্তু মাড়িতে যখন অতি মাত্রায় প্রদাহ হয়, তখন তা ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। কিছু গবেষক মনে করেন যে মাড়ির রোগের প্রদাহ কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমের ক্ষতি করতে পারে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মাড়ির রোগ ভালো হয়ে গেলে রক্তপ্রবাহে প্রদাহের মাত্রা কমে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে ধমনীর কার্যকারিতাকে বাড়ায়।
অন্যান্য গবেষণায় আরো দেখানো হয়েছে যে মাড়ির রোগের চিকিৎসা দেহের সামগ্রিক প্রদাহকে কমায়।
এই গবেষণাগুলো এটি প্রমাণ করে যে কিভাবে মুখের একটি রোগ শরীরের অন্যান্য অংশের টিস্যুর কার্যকারিতার ওপর উল্লেখ্যযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এবং এইসব কিছু বিবেচনা করে এটি অনায়াশেই বলা যায় যে মাড়ির রোগের চিকিৎসা না করেই অনেক মানুষ দশকের পর দশক ধরে জীবনযাপন করে। এতে করে তাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে।
৩. কোলন এবং রেকটাল ক্যান্সারের
ওরাল ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই পাকস্থলীর মাধ্যমে অন্ত্রে ভ্রমণ করে। সাধারণত, আমাদের মুখে যেসব মাইক্রোবস বা জীবাণু থাকে, সেগুলো এই নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়।
কিন্তু ২০১৪ সালে দু’টি গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু ধরনের কোলন ও রেকটাল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ফুসোব্যাকটেরিয়াম নামক একটি প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বেশি দেখা গেছে। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া সাধারণত ডেন্টাল প্লাকে (দাঁতের ওপর লেগে থাকা খাদ্য কণার শক্ত আবরণ) থাকে।
দু’টি গবেষণাতে আরো দেখা গেছে যে ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার কোষের প্রতি এটির ঝোঁক বেশি। কারণ ক্যান্সার কোষের উপরিভাগ এই ব্যাকটেরিয়াকে টিউমারের সাথে যুক্ত হতে ও আক্রমণ করতে দেয়।
একাধিক গবেষণা এখন নিশ্চিত করেছে যে ব্যাকটেরিয়াটি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট (পাকস্থলি এবং অন্ত্র সম্পর্কিত নালী, যেটিকে সংক্ষেপে জিআই ট্র্যাক্ট বলে) জুড়ে টিউমার তৈরি করতে পারে।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে ফুসোব্যাকটেরিয়ামের আধিক্যের কারণে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা কেমোথেরাপিতে খুব একটা সাড়া দেয় না। এবং যেসব কোলন ক্যান্সার আক্রান্তদের শরীরে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি থাকে না, তাদের তুলনায় ওনাদের আয়ু কম থাকে।
এটি হতে পারে কারণ ফুসোব্যাকটেরিয়াম দ্বারা সংক্রমিত টিউমারগুলো বেশি আক্রমণাত্মক। শুধু তাই নয়, এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত টিউমারগুলোর ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বেশি।
কোলন ক্যান্সারের সাথে এই ব্যাকটেরিয়ার সম্পর্ক নিয়ে এবং যারা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছেন, তাদের মুখের জীবাণুর বিরুদ্ধে কোনো টিকা দেয়া যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।
৪. আলঝেইমার্স রোগ
মুখের স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত রোগগুলোর মাঝে যেটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক, তা হলো আলঝেইমার্স (মস্তিস্কের এক ধরনের রোগ, যার ফলে কিছু মনে রাখতে না পারে না রোগী) রোগ।
দাঁতের ব্যাকটিরিয়াঘটিত সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট পেরিওডনটিটিস, যেটিকে পায়োরিয়া বলা হয়; এর সাথে আলঝেইমার্স রোগের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু যেহেতু পেরিওডনটাইটিস ও আলঝেইমার্স, দু’টি রোগই বার্ধক্যের সাথে সম্পর্কিত, তাই এটি নির্ধারণ করা বেশ কঠিন যে এর পেছনে কোনো সুস্পষ্ট কারণ আছে কি না।
২০১৯ সালে গবেষকরা প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন যে আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে পি জিনজিভাইলস-এর উপস্থিতি বেশি। এটিও মাড়ির রোগের অন্যতম প্রধান ব্যাকটেরিয়া।
সাধারণত মস্তিষ্ক হলো শরীরের জীবাণুমুক্ত একটি অংশ। তাই, এটি মুখের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে, বিষয়টি বিতর্কিত থেকে গেছে। এটি নিয়ে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
যেসব রোগীদের মুখ অপরিষ্কার, তাদের ক্ষেত্রে আলঝেইমার্স রোগ হওয়ার সুযোগ থাকে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে মাড়ির রোগের কারণে সৃষ্ট প্রদাহ থেকেও হৃদরোগ হতে পারে বলা হয়েছে।
মুখের ভালো স্বাস্থ্য
স্বস্তির খবর হলো, মুখের মাইক্রোবায়ো পরিচালনা করার ও রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের আছে।
মুখের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অপরিহার্য। এর মাঝে আছে দিনে দু’বার দাঁত ব্রাশ করা এবং দাঁতের গোড়ায় জমে থাকা খাবার পরিষ্কার করার জন্য নিয়মিত ফ্লস করা। এগুলো দাঁতের রোগের প্রকোপ কমাবে।
আর, যদি আপনি ধূমপান করেন, তবে তা ছেড়ে দিলে মাড়ির রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
এছাড়া, মুখের স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক পরামর্শের জন্য আপনার প্রতি ছয় মাস পর পর একজন ডেন্টিস্ট বা হাইজিনিস্টের কাছে যাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।
এ কয়েকটি কাজ করলে আপনার হাসিই শুধু সুন্দর হবে না, এটি আপনার আয়ুও বাড়াতে পারে।
সূত্র : বিবিসি