০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা

- সংগৃহীত

গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের পরিসংখ্যান বলছে, তিন বছর আগেও যেখানে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে ছিল, কিন্তু সর্বশেষ দু’বছরে নতুন করে বাড়ছে মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা।

মূলত বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা এবং সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলাকে ম্যালেরিয়া প্রবণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কিন্তু সম্প্রতি ঢাকাতেও ম্যালেরিয়াবাহী অ্যানোফিলিস মশার অস্তিত্ব মিলেছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা।

বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হল ম্যালেরিয়া। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়।

বাংলাদেশে মোট ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা দেখা যায়, এদের মধ্যে সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে ২০২১ সাল পর্যন্ত কমেছে।

কিন্তু ২০২২ এবং ২০২৩ সালে সে সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করে। যদিও আক্রান্তের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম।

ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে দেশে ম্যালেরিয়ায় সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে।

ওই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল ৫৭ হাজার ৪৮০জন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৪৫ জনের।

এরপর ২০১৫ সালে আক্রান্ত হয় ৩৯ হাজার ৭১৯ জন, তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় নয়জনের।

পরের বছর ২০১৬ সালে আক্রান্তের সংখ্যা কমে ২৭ হাজারে নামলেও মৃত্যু আবার বেড়ে যায়। সে বছর মৃত্যু ১৭ জনের।

এরপর ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয় ২৯ হাজার ২৪৭ জন, যাদের ১৩ জনের মৃত্যু হয়।

পরের বছর ২০১৮ সালে আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ৫২৩ জন আর মৃত্যু হয় সাতজনের।

কিন্তু পরের বছরই আবার আক্রান্তের হার বেড়ে যায়, ২০১৯ সালে আক্রান্ত হয় ১৭ হাজার ২৫৫ জন। আর মৃত্যুর সংখ্যা ছিল নয়জন।

এরপর ২০২০ এবং ২০২১ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল আগের ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

কোভিড মহামারির বছর ২০২০ সালে ছয় হাজার ১৩০ জন আক্রান্ত হয় ম্যালেরিয়ায়। পরের বছর ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল সাত হাজার ২৯৪।

ওই দু’বছরই মৃত্যু হয় নয়জন করে।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে আবার বেড়ে যায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা। সে বছর ১৮ হাজার ১৯৫ জন আক্রান্তের বিপরীতে মৃত্যু হয় ১৪ জনের।

এরপর ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয় ১৬ হাজার ৫৬৭ জন, বিপরীতে মৃত্যু হয় ছয়জরের।

সর্বশেষ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ১৫৮ জন, এদের মধ্যে একজনের মৃত্যুও হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়োপযোগী উদ্যোগের অভাবে বাংলাদেশ থেকে ম্যালেরিয়া পুরোপুরিভাবে নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাচ্ছে না।

এই মুহূর্তে দেশের ১৩টি জেলার ৭২টি থানায় ম্যালেরিয়া রোগের উপস্থিতি রয়েছে। মূলত পার্বত্য ও সীমান্ত এলাকাতেই ম্যালেরিয়া বেশি দেখা যায়।

এ রোগ গ্রীষ্মকালে হয়।

ঢাকা কি ঝুঁকিতে?
বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা এবং সীমান্ত এলাকার মোট ১৩টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এর মধ্যে বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ তিনটি জেলার মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বান্দরবান। বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও থানচি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে সারাদেশে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৫৬৫, এই আক্রান্তদের মধ্যে ১০ হাজারই বান্দরবানের বাসিন্দা।

বান্দরবানের পরই রয়েছে রাঙ্গামাটি জেলা। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত বছর চার হাজার ৭১৩ জন আক্রান্ত হয়েছে রাঙ্গামাটিতে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৩টি জেলা বাদে বাংলাদেশের বাকি ৫১ জেলায় ম্যালেরিয়া রোগের ঝুঁকি নেই।

তবে সম্প্রতি ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশারের নেতৃত্বে একদল গবেষক ফাঁদ পেতে মশা ধরে একটি গবেষণা শুরু করেছেন।

এতে গবেষক দলের ফাঁদে ঢাকায় ধরা পড়েছে ম্যালেরিয়াবাহী অ্যানোফিলিস মশা।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, দেশে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব রোধে পদক্ষেপ নেয়ার দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এবারই প্রথম এই মশার অস্তিত্ব পেয়েছে গবেষক দল।

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ম্যালেরিয়ার বাহক আমি ঢাকায় পেয়েছি। যেহেতু ঢাকায় ম্যালেরিয়ার অস্তিত্ব মিলেছে সে কারণে ঢাকায় ম্যালেরিয়ার ভেক্টর নিয়ে সার্ভিলেন্স (নজরদারি) জোরদার করা জরুরি।’

ঢাকায় ম্যালেরিয়ার বাহক পাওয়ার পরপরই গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক বাশার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঢাকা অফিসকে বিষয়টি জানিয়েছেন।

তবে অধ্যাপক বাশারের এই দাবির সাথে একমত নয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, তারা গণমাধ্যমের খবরে বিষয়টি জানলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি তারা জানেন না।

এমনকি স্বাস্থ্য অধিদফতরের কীটতত্ত্ববিদদের কোনো গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে আসেনি, ফলে তারা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত নন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির কর্মকর্তা ডা. শ্যামল কুমার দাস বলেন, ‘আমরা বছরে তিনবার কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে জরিপ চালাই। এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো জরিপে ঢাকায় ম্যালেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।’

এই কর্মকর্তা মনে করেন, ঢাকায় যে লার্ভা পাওয়া গেছে সেটি অ্যানোফিলিস মশা হলেও তা ম্যালেরিয়ার ভেক্টর না। অর্থাৎ এই মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা কম।

ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে কী করা হচ্ছে
বাংলাদেশে আজ বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়োপযোগী উদ্যোগের অভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারের ‘জিরো ম্যালেরিয়া’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না।

সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ম্যালেরিয়া পুরোপুরিভাবে নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

এ জন্য সরকার নানা কর্মসূচি পালন করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবস্থাপনাসহ নানা দুর্বলতার কারণে আগামী ছয় বছরের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষ ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, কয়েক বছর আগেও ম্যালেরিয়া নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘সেটি অব্যাহত থাকলে সরকার তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারতো। কিন্তু বর্তমান কৌশলে ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া পুরোপুরিভাবে নির্মূল সম্ভব হবে না।’

তবে জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির কর্মকর্তা ডা. দাস বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে তারা কর্মপরিকল্পাগুলো ভাগ করে নিয়েছেন, যাতে যে কোনো মূল্যে আক্রান্ত ও মৃত্যু বন্ধ করা যায়।

তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘এখন ম্যালেরিয়া নির্মূলে শুধুমাত্র কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ ও কর্মীদের মাধ্যমে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে। এই দুই পদ্ধতি ম্যালেরিয়া কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকছে, পুরোপুরি নির্মূল হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক এই পরিচালক বলেছে, আগে ঢাকায় শতাধিক হটস্পট নির্ধারণ করে সেগুলোতে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণের কারণে ম্যালেরিয়া অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ হয়েছিল।

তবে পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় এই প্রক্রিয়ায় ম্যালেরিয়া নির্মূলে কিছু সঙ্কট রয়েছে বলেও জানান এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

ম্যালেরিয়ার কেন হয়? লক্ষণ কী?
স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়। বাংলাদেশে মোট ৩৬ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা দেখা যায়, এদের মধ্যে সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এই সাত প্রজাতির মধ্যে চারটি প্রজাতি ম্যালেরিয়ার প্রধান বাহক বাংলাদেশে।

সংক্রমিত অ্যানোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া শুরু হয়। পরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু লালার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং যকৃতে পৌঁছে। সেখানে তারা পরিপক্ব হয় এবং বংশ বৃদ্ধি করে।

অ্যানোফিলিস মশা যখন অন্য কাউকে কামড়ায়, তখন তার রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ছড়ায় এবং সেও আক্রান্ত হয়। ম্যালেরিয়াবাহী মশা মূলত সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে কামড়ায়।

চিকিৎসকরা বলছেন, কারো ম্যালেরিয়া হলে কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায়।

এই রোগের প্রধান লক্ষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা। জ্বর ১০৫-১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে।

তবে অনেক সময় জ্বর আসা-যাওয়া করে নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে, যেমন একদিন পর পর জ্বর এসে তা তিন-চার ঘণ্টা দীর্ঘ হতে পারে। এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর কমে যায়।

এছাড়া অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে :

  • মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত
  • মাথা ধরা
  • অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, কোষ্ঠকাঠিন্য
  • বমি বমি ভাব ও বমি
  • হজমে সমস্যা
  • অত্যধিক ঘাম হওয়া
  • খিচুনি
  • পিপাসা কম লাগা
  • ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা
  • মাংসপেশি বা তলপেটে ব্যথা
  • রক্তশূন্যতা

যেভাবে মশাবাহিত রোগ থেকে সুস্থ থাকবেন
মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ আক্রান্ত হওয়ার পর সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হলে মৃত্যুসহ নানা ধরণের জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কীটতত্ত্ববিদেরা মশাবাহিত রোগ থেকে বাঁচার জন্য কয়েকটি উপায় বলছেন, যা এরকম
ঘুমানোর সময় মশারি খাটিয়ে ঘুমাতে হবে
মশার কামড় থেকে বাঁচতে নানা ধরণের রিপেলেন্ট অর্থাৎ মশা তাড়ানোর পণ্য যেমন বিভিন্ন ধরনের কয়েল, স্প্রে, ক্রিম জাতীয় পণ্য ব্যবহার করা, তবে এর মাত্রা ও প্রয়োগ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
তবে এগুলো সবই মশাবাহিত কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগের সতর্কতা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরাণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement