গরম কমাতে ৫টি ‘প্রচলিত ধারণা’ কতটা কার্যকর
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০২, আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৫
গ্রীষ্মের প্রখর তাপে অতিষ্ঠ জনজীবন। গরম থেকে বাঁচতে এসি বা ফ্যানের ব্যবহার যেমন দেখা যায়, পাশাপাশি কিছু প্রচলিত কলাকৌশলের শরণাপন্নও হতে দেখা যায় অনেককে।
সেসব কতটা কাজে দেয়? গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে নেয়া এসব কায়দার ব্যাপারে চিকিৎসকরাই বা কী বলছেন?
মাথা ন্যাড়া করলে কী লাভ?
বাংলাদেশে গরমের দিনের মাথা ন্যাড়া করার প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মধ্যে। বিশেষ করে শিশুদের মাথার চুল ফেলে দেন কোনো কোনো মা-বাবা।
‘এতে মাথায় বাতাস লাগে, তেমন ঘামে না,’ বলছিলেন একজন অভিভাবক।
চিকিৎসকরাও সাধারণত চুল ছোট রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে, তার জন্য একদম ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
এভারকেয়ার হাসপাতালের ডার্মাটোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. রুবাইয়া আলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘চুল ছোট থাকলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। তবে, এর বাড়তি কোনো হেলথ বেনিফিট (স্বাস্থ্যগত সুবিধা) নেই।’
যাদের পক্ষে চুলের যত্ন নেয়া সম্ভব হয় না, সেসব রোগীদের ‘ট্রিম’ করে রাখতে বলেন ডা. রুবাইয়া আলী।
তবে মাথায় সরাসরি সূর্যালোক যাতে না পড়ে, সেজন্য রোদে বের হলে ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করতে হবে, যোগ করেন তিনি।
টক খেলে গরম কমে?
কাঁচা আম আসতে শুরু করেছে বাজারে। কাঁচা আমের জুসের প্রতি আগ্রহ থাকে অনেকের।
এছাড়া তেতুলের শরবত, লেবুর শরবতের মতো পানীয়েরও বেশ কাটতি থাকে গরমে এই সময়ে। শহরের রাস্তাঘাটে এসব শরবতের বিক্রিও অনেক বেড়ে যায়।
সাধারণ মানুষের মূল খাবারে ভাতের সাথে টক ডালের বা আচারের উপস্থিতিও বাড়ে।
একটা প্রচলিত ধারণা আছে, ‘টক খেলে গরম কমে’।
তবে চিকিৎসকরা বলছেন, টক জাতীয় খাবার গ্রহণের সাথে শরীরের তাপের হ্রাসবৃদ্ধির সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ সালেহ মাহমুদ তুষার বলেন, টক জাতীয় খাবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। সে কারণে সাময়িক স্বস্তি বোধ করেন অনেকেই।
‘তবে, এ ধরনের খাবার গ্রহণ করলেই গরম কম লাগবে, এমন নিশ্চয়তা নেই,’ যোগ করেন তিনি।
চা খেলে গরম কমে?
চা পানীয় হিসেবে এতোই জনপ্রিয় যে প্রচণ্ড গরমেও এই চায়ের দোকানগুলোতে ভিড় চোখে পড়ার মতো।
কেউ কেউ এমন ধারণাও পোষণ করেন যে, গরম চা খেলে বাইরের গরম কম অনুভূত হবে।
এটা একেবারেই ভুল ধারণা বলে অভিমত চিকিৎসকদের।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের এক প্রকাশনা থেকে জানা যাচ্ছে, মানব শরীরে ক্যাফেইন খুব দ্রুত শোষিত হয়। গ্রহণের মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যেই ৯৯ শতাংশ ক্যাফেইন শোষিত হয়ে যায়।
চা বা কফির ক্যাফেইন দেহকে পানিশূন্য করে ফেলে এবং শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে।
এতে অল্প সময়েই শরীরের তাপমাত্রা অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে।
অল্প সময়ে শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন গরমের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ‘হিটস্ট্রোক’র ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে জানান কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ডা. শেখ মইনুল খোকন।
কারণ চা-কফি পানের পর পাকস্থলীতে গরম পানির বাড়তি তাপ শরীরের ভেতরটাকেও গরম করে তোলে। তাই এই সময়ে চা-কফি, অ্যালকোহল, নিকোটিন সবই এড়িয়ে চলতে বলছেন, ডা. সালেহ মোহাম্মদ তুষার।
তবে অনেকে আছেন যাদের সকালে বা বিকেলে কিংবা উভয় বেলায় একান্তই এক কাপ চা না খেলে চলে না। তাদের চা খাওয়ার আগেই খানিকটা পানি পান করে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন মোহাম্মদ তুষার।
তিনি বলছেন, ‘এতে তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় থাকবে।’
স্যালাইন কতটা কাজের?
গরমের সময় স্যালাইন খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় অনেকের মাঝে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ উপদেশ দিচ্ছেন, যারা বাইরে হবেন তারা যেন সাথে স্যালাইন রাখেন।
পানিশূন্যতা রোধে স্যালাইনের পাশাপাশি ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয়ও গ্রহণ করেন অনেকে।
‘বাইরে যারা কাজ করছেন, তারা যদি বেশি ঘেমে যান, স্যালাইনটা তখন তাদের জন্য বেশি জরুরি,’ বলছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক ডা. তুষার।
অন্যথায়, কেবল গরম লাগলেই স্যালাইন খাওয়ার প্রয়োজন নেই, বলছেন তিনি।
অতিরিক্ত স্যালাইন বা ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয় গ্রহণের ঝুঁকি সম্পর্কেও সতর্ক করেন চিকিৎসকরা।
তবে যাদের ডায়াবেটিস বা কিডনি জটিলতা আছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে স্যালাইন না খাওয়াই ভালো। কারণ, তাতে জটিলতা বাড়তে পারে।
বার বার গোসল করলে কোনো অসুবিধা আছে?
নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোনো নদ-নদীতে কিশোরদের দাপাদাপি বা দুরন্তপনার দৃশ্য বিভিন্ন সময় দেখা যায় স্থানীয় গণমাধ্যমে।
গরমের দিনে পানিতে নেমে গোসল বা শরীর ভিজিয়ে বসে থাকার জন্য জলাশয় দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
তবে, ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বা এনএইচএস বলছে, কোথাও পুকুর বা জলাশয় দেখলেই নিজেকে ঠাণ্ডা করার জন্য সেখানে নেমে পড়বেন না। কারণে তাতে আরো অনেক বেশি বিপদ হতে পারে, যা হয়তো আপাতত চোখে পড়ছে না।
এভারকেয়ার হাসপাতালে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুবাইয়া আলী বলেন, অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা কোনোটাই ত্বকের জন্য ভালো নয়। ঠাণ্ডা পানিতে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। ত্বকের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এতে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ডা. তুষারের মতে, একাধিকবার গোসল করলেও বার বার মাথা না ভেজানোই ভালো। তাতে ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।
ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বা এনএইচএস ত্বক ঠাণ্ডা রাখতে কিছু পরামর্শ দেয়। যেমন, শরীরে ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দেয়া কিম্বা স্পঞ্জ করে গা মুছে দেয়া।
ঘাড়ে এবং বগলের নিচে বরফের প্যাকেট রেখেও শরীর ঠাণ্ডা রাখা যেতে পারে।
ঠাণ্ডা পানি খেলে কী হয়?
তীব্র দাবদাহের একটু প্রশান্তির খোঁজে ঠাণ্ডা পানির গ্লাস হাতে তুলে নেন অনেকেই।
তবে বেশি ঠাণ্ডা পানি খেতে বারণ করেন চিকিৎসকরা। এতে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা প্রকট হতে পারে।
শরীরে তাপমাত্রায় ভারসাম্যহীনতাও দেখা দিতে পারে। ফলে, জ্বর, সর্দি, কাশিতে ভুগতে হতে পারে বলে সতর্ক করেন ডা. তুষার।
পাকস্থলীতে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পানি প্রবেশ করলে হজমেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এসব সমস্যা এড়াতে স্বাভাবিকের চেয়ে অল্প ঠাণ্ডা পানি পানের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
খোলা স্থানে বরফ মেশানো পানি বা শরবত খেলে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।
সূত্র : বিবিসিৃ