০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`
রাজধানীতে বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে

পারিবারিক প্রথা দুর্বল হচ্ছে

-

বাংলাদেশের জীবনধারার প্রধান একটা ইতিবাচক গুণ ছিল শক্ত পারিবারিক সম্পর্ক। পারিবারিক ইউনিট ক্ষুদ্র হোক কিংবা সেটা বৃহৎ বা যৌথ হোক সদস্যদের মধ্যে সৌহার্দ্য মায়া মমতার ঘাটতি ছিল না। সামাজিক স্থিতির জন্য এটি একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এই পারিবারিক বন্ধনের সাথে সাথে সামাজিক সম্প্রীতি এখন ক্ষয় হতে শুরু করেছে। কিছু লক্ষণ দেখে সেটা পরিষ্কার করে বোঝা যায়। সহযোগী পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার দম্পতিদের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ আশঙ্কাজনক বাড়ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অচিরেই আমরা পারিবারিক বন্ধনের উষ্ণতা হারিয়ে ফেলা পশ্চিমাদের কাতারে পৌঁছে যাবো। সময় থাকতে বিষয়টি নিয়ে সমাজের ভেতর থেকে সচেতনতামূলক সাড়া প্রয়োজন।
পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মাত্র এক দশকে রাজধানীতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। বৈষয়িক জীবন এতটাই গুরুত্ব পাচ্ছে; সামান্য পাওয়া না পাওয়া সম্পর্কের একমাত্র নির্ধারক হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আরেকটি নেতিবাচক প্রবণতা হচ্ছে, নারীদের তালাক চাওয়ার হার পুরুষের চেয়ে বেশি। গত এক যুগের প্রবণতা লক্ষ করে দেখা যাচ্ছে, নারীদের বিচ্ছেদ চাওয়ার এই উচ্চ হার সমানতালে বাড়ছে। ২০১১ সালে ঢাকা উত্তর সিটিতে দুই হাজার ৮৬৪টি বিচ্ছেদ আবেদনের মধ্যে এক হাজার ৭৭৩টি করেছে নারীরা। ২০২২ সালে নভেম্বর পর্যন্ত উত্তর সিটিতে সাত হাজার ৬৯৮টি আবেদনের মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৮৩টি নারী। এক যুগে উত্তর সিটিতে ৫৮ হাজার ৩০টি তালাকের আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৭৯২টি আবেদন করেছে নারীরা। ঢাকা দক্ষিণে এই প্রবণতা তার চেয়েও দ্রুত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পত্রিকার বিবরণ মতে, এখানে গত তিন বছরে তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ২১ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৯৯৪টি আবেদন করেছে নারীরা।
বিয়ে বিচ্ছেদের হার দ্রুত বাড়ার পেছনে নারীরা এগিয়ে থাকলেও এজন্য যে নারীরা এককভাবে দায়ী, সেটা বলার সুযোগ নেই। বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদনের নথিপত্র ঘেঁটে যা পাওয়া যাচ্ছে এজন্য পুরুষদের দায়ভার তার চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে পাওয়া গেছে অর্থ খরচে অনীহা, স্বামীর মাদকাসক্ত হওয়া, যৌতুক গ্রহণ ও মানসিক পীড়ন। এমন কারণগুলোর ক্ষেত্রে প্রধানত পুরুষরা দায়ী থাকে। সন্দেহবাতিকতা, যৌন অক্ষমতা ও সংসারের প্রতি উদাসীনতার মতো কারণগুলোকে ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনপত্রে। শেষের কারণগুলো ক্রমেই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরকীয়ার কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে ভোগবাদী যে ককটেল সংস্কৃতির আবির্ভাব হয়েছে, সেটা অবক্ষয়কে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কেউ কেউ বলছেন, নারীরা আগের চেয়ে অধিক হারে শিক্ষিত হচ্ছে। ফলে তারা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে অধিক সচেতন। তাই কোনো ধরনের বঞ্চনার শিকার হলে বিচ্ছেদের পথে হাঁটছে। অথচ প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে সহনশীল করার কথা। একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল করার কথা। পরিবারের প্রতি যতœশীল করে তোলার কথা। কিন্তু আমরা কোন শিক্ষা গ্রহণ করছি, যাতে আমরা হয়ে উঠছি চরম অসহিষ্ণু? অল্পতে একে অপরের ওপর আস্থা হারিয়ে সংসার ভেঙে দিচ্ছি। তবে নারীদের প্রতি নির্যাতন অবহেলার বিষয়গুলো রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কথিত শিক্ষা বা সচেতনতার চেয়ে বেশি দায়ী সম্ভবত স্ত্রীর পরিবার থেকে কিছু পাওয়ার লোভ। কিছু স্বামী রয়েছে বিকারগ্রস্ত, তারা স্ত্রীদের নির্যাতন না করে থাকতে পারেন না। সংসারের দায়দায়িত্ব অবহেলা করে অনেকে সামাজিকমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়েন। এই অতিরিক্ত আসক্তি পরকীয়ার মতো সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। তা থেকে সৃষ্ট অশান্তি শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে গড়াচ্ছে।
সমগ্র দেশে তালাকপ্রবণতা বেড়ে গেছে। সাদা চোখে সেটা দেখা যায়, মূলত আমাদের মধ্যে বৈষয়িকতা এখন এতটা প্রাধান্য পেয়েছে সব কিছুকে আমরা টাকার অঙ্কে হিসাব করছি। কোথাও সামান্য ঘাটতি দেখলে তা আমরা আর সহ্য করছি না। এর একটা পরিণতি হিসেবে পরিবার প্রথা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। শিশুরা পাচ্ছে না উপযুক্ত যত্ন ও পিতা-মাতার মমতা। এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বাড়বে। সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তকদের এসব নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement