০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

নিপাহ ভাইরাস : সতর্ক হোন

-

এ বছর এখন পর্যন্ত আটজন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন। এ বছর রাজশাহীতে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে মারা গেছেন দু’জন। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে সাত বছরের শিশু। এ বছর অন্যান্য এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে এ বছর নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের হার বেশি। গেল বছরও বেশ কয়েকজন নিপাহ ভাইরাসে আক্রমণে মারা গেছেন।

১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপাহ ভইরাস শনাক্ত করা হয়। এ সময় ২৫৭ জন আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১০৫ জন। মালেশিয়ার কেমপুং নিপাহ শহরে এ ভাইরাস প্রথম সংক্রমিত হয় বলে এর নামানুসারে নিপাহ ভাইরাস রাখা হয়।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি ধরা পড়ে ২০০১ সালে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে মানব দেহে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। গেল বছর উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় প্রথম এ ভাইরাস ধরা পড়ে। পরে কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুরেও সংক্রমণের ঘটনা ঘটে। ২৪ জন আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন মারা যায়। এর আগে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ফরিদপুরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে জানা গেছে অসতর্কভাবে অন্য রোগীর সেবা করার কারণে সংক্রমণের হার বেড়েছে। এ পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ৩২৫ জনের মধ্যে ২৫০ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। এ ভাইরাসে আক্রান্তদের মারা যাওয়ার হার ৭১ ভাগের বেশি। তবে এটা নিয়ে ভয় পেলে চলবে না। সচেতন হতে হবে।

নিপাহ ভাইরাস হেনিপাহ ভাইরাস গোত্রের। এ গোত্রের আর একটি ভাইরাস হলো হেনড্রা ভাইরাস। হেনড্রা ভাইরাস ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন এ শনাক্ত করা হয়। এ সময় এ ভাইরাসের সংক্রমণে ৩০টি ঘোড়া মারা যায়। এ ভাইরাস শুধু ঘোড়াকে সংক্রমিত করলেও মানুষকে সংক্রমিত করার খবর পাওয়া যায়নি। নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এই সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সাথে তাদের লালা মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ। আক্রান্ত ব্যক্তির থুথু, লালা, মলমূত্রের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। নিপা ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৪ থেকে ৪৫ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এ কারণে গত এক মাসে যারা খেজুরের রস খেয়েছেন, তাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। যারা রোগীদের সেবা দিয়েছেন এবং মৃতদের সৎকার করেছেন, তাদের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথমে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লক্ষণ যেমন প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, গলায় ক্ষত, বমি হওয়া দেখা দেয়। পরে মাথা ঘোরানো, খিচুনি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। একপর্যায়ে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

এ রোগে সঠিক কোনো ওষুধ বা প্রতিরোধক কোনো ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। আশা করা হচ্ছে আগামী বছর এ ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হবে। তাই এ রোগ প্রতিরোধে সচেতন থাকতে হবে। এ রোগে আক্রান্তদের পরিচর্যা করতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগীর ব্যবহৃত কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার না করে আবার ব্যবহার করা যাবে না। রোগীর পরিচর্যা করার পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। রোগীর কফ ও থুতু যেখানে সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যার সময় মাক্স ব্যবহার করতে হবে।
নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে খেঁজুরের কাঁচা রস না খাওয়া, বাদুড় বা অন্য প্রাণীর খাওয়া আংশিক ফল না খাওয়া, ফলমূল ভালো করে ধুয়ে খাওয়া, আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলা। এ ছাড়া আক্রান্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় খেজুর গুড় ও রস, আখের রস, পেঁপে, পেয়ারা, বরইয়ের মতো ফল না খাওয়া ভালো।

লেখক : নিউরোলজিস্ট, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement