০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ

-

বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস একটি অন্যতম রোগ এবং এর কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়। ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ এর মধ্যে অন্যতম। ডায়াবেটিসের প্রভাবে শারীরিক যেকোনো অঙ্গ বা সিস্টেম আক্রান্ত হতে পারে। কিডনি রোগের ওপর প্রধানত ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি এবং কিডনি বা প্রস্রাবনালীতে সংক্রমণ অন্যতম।

ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি কী?
কিডনি সম্পূর্ণভাবে বিকল বা অকেজো হওয়ার কারণসমূহের মধ্যে উন্নত দেশে ডায়াবেটিসকে প্রধান এবং আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে একে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস রোগীদের বেলায় এই রোগের হার শতকরা ৪০-৫০ ভাগ এবং যারা ইনসুলিন নির্ভরশীল নন তাদের বেলায় শতকরা ১৫-২০ ভাগ। সাধারণত ইনসুলিন নির্ভরশীল ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগের কারণে কিডনিতে প্রাথমিক বিপর্যয় শুরু হয় ৭-১০ বছরের মধ্যে, যখন কোনো উপসর্গই থাকে না শুধু প্রস্রাবে প্রোটিনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এবং ১০-১৫ বছরের মধ্যে প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় তখন তাকে বলা নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম এবং এই সময়ে রোগীর শরীরে পানি আসা শুরু হয়। আর ১৫-২০ বছরের মধ্যে কিডনির কার্যক্রম হ্রাস পেতে থাকে। তখন একে ধীরগতিতে কিডনি ফেইলিউর বলা হয়।
উপসর্গ
প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির কোনো উপসর্গ থাকে না। উপসর্গ যখন দেখা যায় তত দিনে কিডনির অনেকটা ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রধান প্রধান উপসর্গগুলো হচ্ছে পায়ে পানি আসা এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়া। এদের পরীক্ষা করে চোখের ও স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতার উপস্থিতিও লক্ষ করা যায়। সাধারণত ডায়াবেটিস হওয়ার ৫-১৫ বছর পরে এ ধরনের জটিলতা দেখা যায়। এই পর্যায়ে চিকিৎসায় খুব ভালো ফল লাভ সম্ভব হয় না। এ জন্যই প্রতিদিন এসব রোগীকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই প্রস্রাবে অ্যালবুমিন আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। আমরা যে পদ্ধতিতে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন পরীক্ষা করে থাকি তাতে ২৪ ঘণ্টায় অ্যালবুমিন ৩০০ মি.গ্রা.-এর উপরে গেলেই ধরতে পারি। কিন্তু ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবে অ্যালবুমিনের পরিমাণ ৩০ মি.গ্রা. গেলেই বলা হয়ে থাকে যাকে মাইক্রোঅ্যালবুমিন ইউরিয়া।

পরীক্ষাপদ্ধতি
প্রাথমিক পর্যায়ে শারীরিক পরীক্ষা করে উল্লেখযোগ্য কিছুই ধরা পড়ে না। তবে সময়ের তারতম্য হিসাবে ডায়াবেটিস রোগের জটিলতা, চোখের রেটিনোপ্যাথি বিভিন্ন প্রকার চর্ম ও স্নায়ু রোগের অবস্থান পরীক্ষা করে ধরা পড়ে। প্রতিটি ডায়াবেটিসের রোগীর সকালের প্রস্রাব পরীক্ষা করে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন বা আমিষ, সুগার বা শর্করা আছে কি না তা দেখা উচিত। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রস্রাবে লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা ও কাষ্ট দেখা হয়। যদি প্রস্রাবে শ্বেত কণিকা পাওয়া যয়, প্রস্রাব কালচারের মাধ্যমে জীবাণুজনিত ইনফেকশন আছে কি না তা নির্ণয় করা হয়ে থাকে। ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাব পরীক্ষা করে কত পরিমাণ অ্যালবুমিন যাচ্ছে তা নির্ণয় করা হয়। ২৪ ঘণ্টায় অ্যালবুমিন ৩০০ মি.গ্রা. এর উপরে গেলেই ডায়াবেটিস নেফ্রোপ্যাথি ভাবা হয়। প্রতিটি রোগীর রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বনেট পরীক্ষা করে দেখা হয়। প্রস্রাবে যদি ৩০০ মি.গ্রা.- এর উপরে অ্যালবুমিন যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে রক্তে ইউরিয়া ও ক্রিটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে তখন কিডনি অকেজো হওয়ার প্রাথমিক পর্যায় ধরা হয়। ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবে যদি অ্যালবুমিন ৩ গ্রামের উপরে যায় তাহলে রোগীর শরীরে পানি জমতে শুরু করে তখন একে নেফ্রোটিক সিন্ড্রোম বলে। প্রতিটি রোগীর রক্তের কোলেস্টেরলও একই সঙ্গে দেখে নেওয়া উচিত। হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস শরীরে আছে কিনা তাও জেনে নেয়া প্রয়োজন। কিডনির সনোগ্রাম করে তার অবস্থান প্রস্রাবের রাস্তা ও থলির অবস্থা জেনে নেয়া উচিত। প্রয়োজনবোধে কিডনির বায়োপসি পর্যন্ত করা যেতে পারে। ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যথি ছাড়াও ডায়াবেটিক রোগীর প্রস্রাবে জীবাণুজনিত ইনফেকশন এবং স্নায়ুতন্ত্রের বৈকল্য রোগে ভুগতে থাকে। অনেকের নেফ্রাইটিস জাতীয় রোগও একই সাথে থাকতে পারে। তাই এসব রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।
চিকিৎসা ব্যবস্থা
ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির চিকিৎসা নির্ভর করে ডায়াবেটিস দ্বারা কিডনি কতখানি আক্রান্ত হয়েছে তার ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিস রোগীর নেফ্রোপ্যাথি ধরার সাথে সাথে উচ্চরক্তচাপ হওয়ার লক্ষণও দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে রোগীর ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণের ভিতরে আনা হয়। এর সাথে খাবারের তালিকা সঠিক আছে কিনা তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হয়। প্রস্রাবে যদি অ্যালবুমিন নির্গত হয় তাহলে এসিই ইনহেবিটর জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। এসিই ইনহেবিটর জাতীয় ওষুধ কিডনির ছাকনির ওপর কাজ করে। অ্যালবুমিন নির্গত হওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। রোগীর যদি এ পর্যায়ে উচ্চরক্তচাপ থাকে তাহলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং তা এসিই ইনহেবিটর দ্বারা করাই শ্রেয়। এই ওষুধ দ্বারা যদি রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে এবং প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হওয়ার পরিমাণ কমানোর ব্যবস্থা করে নেফ্রোপ্যাথি হওয়ার পরেও কিডনি অকেজো হওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমে যায়। রোগী যখন ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির সাথে উচ্চরক্তচাপ এবং রক্তে ইউরিয়া/ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে কিডনি ফেইলিউর লক্ষণসমূহ নিয়ে আসে তখন এদের চিকিৎসার জটিলতা হয়। এসব ক্ষেত্রে প্রস্রাবে আমিষ নির্গত হওয়া কমানোর জন্য এসিই ইনহেবিটর জাতীয় ওষুধ দেয়ার পূর্বে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা কিডনির কাজ বেশি লোপ পেয়ে গেল এসিই ইনহেবিটর জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এতে রক্তে পটাসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায় যা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। এই পর্যায়ে রোগীর খাবারে আমিষের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয় অর্থাৎ রক্তের ক্রিয়েটনিনের ওপর নির্ভর করে আমিষের পরিমাণ ০.৫-০-, ৭৫ গ্রাম প্রতি কেজি শরীরের ওজনের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। অনেক রোগীর ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি হওয়ার পর পা ও পেটে পানি আসে। এসব ক্ষেত্রে খাওয়ার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় যা ২৪ ঘণ্টায় ১ লিটারের মধ্যে রাখা প্রয়োজন।
পানি শরীর থেকে বের করার জন্য ফ্রুসেমাইড বা লুপ ডাইয়ুবেটিক্স জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে এবং কিডনির কার্যকারিতা ও শরীরে পানির পরিমাণ অনুযায়ী ওষুদের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। রোগীর যদি উচ্চরক্তচাপ থাকে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিফেডিপিন বা ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার বা মিথাইল ডোপ জাতীয় ওষুধ নিরাপদ। প্রস্রাবে জীবাণুজনিত ইনফেকশন বা শরীরে কোথাও ইনফেকশন হলেই এন্টবায়টিক ব্যবহারের সময়ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগীদের নিয়মিত পরীক্ষা ও চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা যেমন অত্যাবশ্যক তেমনি প্রাথমিক পর্যায়ে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হওয়ার শনাক্ত করে যথাযথ চিকিৎসা করা উচিত, যাতে করে ডায়াবেটিস এর প্রভাবে দুরারোগ্য কিডনি ফেইলিউরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।


আরো সংবাদ



premium cement