০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

শিশু কি টিভিতে আসক্ত?

-

টেলিভিশন নামক যন্ত্রটি উনিশ শতকের বিস্ময়কর আবিষ্কার। এটি মানুষের চিত্তবিনোদনের অন্যতম উৎস। জাদুর এ বাক্সটি বিশ্ব জয় করে বাংলাদেশেও চলে আসে। প্রথমে এটি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। এখন এটি পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে। এমনকি বস্তিতে, যারা দিন আনে দিন খায়। দেশে এমন ঘরের সংখ্যাও কম নয় যেখানে শুধু লোডশেডিংয়ের সময় টিভি বন্ধ থাকে। চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে টিভির সাথে যোগ হয়েছে সিডি-ডিভিডি প্লেয়ার, কম্পিউটার। আমাদের দেশে প্রতিদিন একজন গড়ে কত ঘণ্টা টিভি দেখেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে আমেরিকায় আছে। দেখা গেছে সেখানে প্রতিদিন একজন গড়ে ৫ ঘণ্টা টিভি দেখেন। আমেরিকার মতো কাজ পাগল মানুষ যদি ৫ ঘণ্টা টিভি দেখেন তাহলে আমাদের মতো অফুরন্ত সময়ের মানুষ কতক্ষণ টিভি দেখেন তা সহজেই অনুমেয়। টিভি বেশি দেখলে সমস্যা কী? না তেমন কোনো সমস্যা নেই। এ জাদুর বাক্স কখন যে আপনাকে যমদূতের কাছে টেনে নিয়ে যাবে তা বুঝতেই পারবেন না।
ডরিমোন, ভীম, মাইটি রাজু, টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের প্রতি আকর্ষণের শেষ নেই। হবে না বা কেন খাওয়ানোর ছলে মায়েরা বোঝার বয়স হওয়ার আগেই তো টিভির সাথে সম্পর্ক করে দেন। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়েট্রিক্সয়ের গবেষণায় দেখা গেছে আমেরিকায় গত ২০ বছরে স্থূল শিশুর হার দ্বিগুণ হয়েছে। পাঁচ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রেও স্থূলতার হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে অতিরিক্ত টিভিকে দায়ী করেছেন তারা। তাদের এ দাবি বেশ কয়েকটি গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত। বলা হচ্ছে অতিরিক্ত টিভি দেখার কারণে শিশুদের কায়িক পরিশ্রম যেমন খেলাধুলা, দুষ্টামি হয় না। এতে এনার্জি ক্ষয় হতে পারে না বলে শিশু মোটা হয়। শিশুর স্থূলতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে। শতাধিক গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা ৮৫ জন স্থূল শিশু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ, উচ্চ কোলেস্টেরল ও মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয়। স্থূল শিশুদের মধ্যে শতকরা ৮০ জনই পরিণত বয়সে স্থূলতায় ভোগে।
আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে এ বছরের শুরুতে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ৬-১০ বছরের প্রায় দুই লাখ শিশুর ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় বলা হয়েছে ২ ঘণ্টা অতিরিক্ত টিভি দেখলে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার শতকরা ১৫ ভাগ, হার্টের সমস্যায় ১০ ভাগ। ৩ ঘণ্টা অতিরিক্ত টিভি দর্শনে মারা যাওয়ার হার বাড়ে ১৩ ভাগ।
অতি চঞ্চল ও অমনোযোগী শিশুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। একটা বারও কি আমরা ভেবেছি এর জন্য টেলিভিশন দায়ী। জন্মের পর কয়েক বছর শিশুর মস্তিষ্কের গঠন কাজ চলে। এ সময় কোটি কোটি নিউরণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এমন সময় টিভি দেখলে এ প্রক্রিয়ায় বিঘœ ঘটে। ১৯৭০ সালে অধ্যাপক ওয়ার্নার হেলপেরিন জানান, টেলিভিশনে দ্রুত শব্দ ও ছবি পরিবর্তিত হয়। এটি শিশুর স্নায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে শিশু সহজেই মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। ২০০৪ সালে জার্নাল পেডিয়েট্রিক্সে বলা হয় ১-৩ বছরের মধ্যে টিভি দেখলে ৭ বছর বয়সে অতি চঞ্চলতা ও অমনোযোগিতা দেখা দেয়। প্রতিদিন ৫ ঘণ্টার বেশি টিভি দেখলে ৭ বছর বয়সে অমনোযোগিতায় আক্রান্তের হার বাড়ে ৩০ ভাগ। তো শিশুদের জন্য কি টিভি পুরোপুরি নিষিদ্ধ? আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়েট্রিক্স সুপারিশ করেছে শিশুর বয়স দুই বছরের আগে টিভি দেখা নিষেধ। ৪ বছরের কম শিশুদের দেড় ঘণ্টার বেশি টিভি দেখা যাবেই না।
পত্রিকায় প্রায় দেখা যায়, আমেরিকার স্কুলে শিশু গুলি চালিয়ে সহপাঠীদের খুন করছে। এটা নিয়ে তারা গবেষণা করেছে কারণ হিসাবে উঠে এসেছে আমেরিকার শিশুদের অতিরিক্ত টিভি দেখা ও হলিউডের মারদাঙ্গা ছবি। টিভি শিশুর মানসপটে কতটা প্রভাব ফেলে এ থেকে সহজেই অনুমেয়। তাই শিশুরা কোন ধরনের অনুষ্ঠান দেখবে তা বাছাই করতে হবে অভিভাবকদের।
আমেরিকার আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে সে দেশের শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন এখনকার দিনে শিশুরা দেরিতে লিখতে শেখে। আগের দিন শিশুরা অবসর সময়ে ছবি আঁকত, ব্যাট-বল দিয়ে খেলত এতে করে হাত ও চোখের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হতো। এখন টিভি দেখায় বেশি সময় ব্যয় করায় এ ধরনের কাজ শিশুরা কম করে বলে লিখতে শেখে দেরিতে।
বেশি টিভি নিয়ে থাকার কারণে শিশুরা নিজেদের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। তারা সহজেই কারো সাথে মিশতে পারে না। একাকিত্ব ও মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হয় সহজেই। এ থেকে রক্ষা পেতে তারা খুঁজে নেয় আত্মহত্যার পথ।
ব্রিটিশ জার্নাল অব স্পোর্টস মেডিসিনের একটি প্রবন্ধে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে ১৯৯৯-২০০০ সালে প্রায় ১২ হাজার ব্যক্তির ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে ১ ঘণ্টা টিভি দেখার কারণে ২২ মিনিট আয়ু কমে! সত্যিই ভয়ঙ্কর এ গবেষণা তথ্য। আরো বলা হচ্ছে যারা দিনে ৬ ঘণ্টা টিভি দেখেন তারা অন্যদের চেয়ে পাঁচ বছর আগেই মারা যান। বেশি টিভি দেখলে বড়রাও মুটিয়ে যান। আক্রান্ত হন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগে। অতিরিক্ত টিভি দেখার করণে পরিবারে সেভাবে সময় দেয়া হয়ে ওঠে না। ফলে দুর্বল হয় পারিবারিক বন্ধন। সংসারে দেখা দেয় অশান্তি।
ধূমপানকে দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর অন্যতম কারণ মনে করা হয়। এটা নিয়ে বেশ প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখা নিভৃতে মৃত্যুর অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছে এটা নিয়ে সচেতন নয় কেউই। অতিরিক্ত টিভি দেখা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা থামাতে হবে এখনই, এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।


আরো সংবাদ



premium cement