০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ফুসফুসের আবরণী পর্দায় পানি জমলে

-

ফুসফুসের আবরণীটি চারদিক থেকে ফুসফুসকে আবৃত করে রাখে ইংরেজিতে একে পুরা বলে। আবরণীটি দুটো পাতলা পর্দার সমন্বয়ে গঠিত। পাতলা পর্দা দুটো পর পর থেকে আলাদা এবং এদের মাঝখানে অল্প পরিমাণে তরল পদার্থ ধারণ করা আপাতত শূন্য স্থান রয়েছে। এদের মধ্যকার শূন্যস্থানটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় ফুসফুসের সঙ্কোচন-প্রসারণে সহায়তা করে।
ফুসফুসকে আবৃত করে রাখা এ পাতলা পর্দা দুটোয় কোনো কারণে প্রদাহের সৃষ্টি হলে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পর্দা দুটোর মাঝখানের আপাতত শূন্য স্থানে থাকা তরলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ তরল পানি, রক্ত পুঁজ ইত্যাদি যেকোনো জাতীয় হতে পারে। অনেক সময় পর্দা দুটোর মাঝখানে শুধু বাতাসও জমতে পারে।
সাধারণভাবে দুই পর্দার মাঝখানে থাকা তরলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তাকে পুরাল ইফিউশান বলে। এ রোগ বুকের এক দিকে বা উভয় দিকেই হতে পারে। রোগী সাধারণত কাশি, শ্বাসকষ্ট, জ্বর এবং যে দিকে তরল জমা বৃদ্ধি পায় সে দিকে বুকে ব্যথা অনুভব করে। অনেক সময় তরল বৃদ্ধির পরিমাণ অল্প হলে রোগী কোনো ধরনের সমস্যা অনুভব নাও করতে পারে।
ফুসফুসজনিত বা ফুসফুসবহির্ভূত কারণে এ ধরনের তরল বৃদ্ধির ঘটনা ঘটতে পারে। প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের এই তরল বৃদ্ধি বা পুরাল ইফিউশনের কারণ এই যক্ষ্মা বা টিবি রোগ। সাধারণত এ ক্ষেত্রে রোগী কাশি, সান্ধ্যকালীন অল্প জ্বর ও দ্রুত ওজন হ্রাসের মতো লক্ষণগুলো অনুভব করে। ফুসফুসজনিত অন্য কারণগুলোর মধ্যে নিউমোনিয়া, ভাইরাসজনিত জ্বর, ফুসফুসের ক্যান্সার অন্যতম। নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী সাধারণত কাশি, কাশির সাথে রক্ত পড়া, উচ্চমাত্রার জ্বর ও আক্রান্ত দিকে তীব্র বুকের ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারে। শিশু ও বয়স্ক রোগীরা এ রোগে অধিক হারে আক্রান্ত হয়। ভাইরাসজনিত ফুসফুস আক্রান্ত হলে পুরিসির সৃষ্টি হয় এবং রোগী শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ফুসফুসের ক্যান্সার হলে তা পুরায় ছড়াতে পারে কিংবা অনেক সময় পুরাতে ক্যান্সার হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই আক্রান্ত দিকে পানি বা তরল জমতে পারে। এসব ক্ষেত্রেও রোগী কাশি, কাশির সাথে রক্ত যাওয়া, জ্বর, বুকে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ অনুভব করতে পারে।
ফুসফুসবহির্ভূত কারণগুলোর মধ্যে অন্যান্য অঙ্গের ক্যান্সার যেমন অন্ত্র, যকৃত, কিডনি, ডিম্বাশয় ইত্যাদি, যদি ফুসফুস বা পুরাল ছড়িয়ে পরে, লিম্ফোমা, কিংবা হার্ট, কিডনি বা লিভারের ফেইলুরের কারণে ফুসফুসের আবরণী পর্দায় পানি বা তরল জমতে পারে। এ ছাড়াও অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, কিডনির প্রোটিন ক্ষয়জনিত রোগ নেফ্রোটিক সিনড্রোম এবং নানারকম বাত রোগের কারণেও ফুসফুসে পানি জমতে পারে।
ফুসফুসের আবরণী পর্দায় জমা হওয়া পানির পরিমাণ অল্প হলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো উপসর্গ তৈরি করে না। পানির পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে উপসর্গ বা লক্ষণগুলোও দেখা দিতে শুরু করে এবং ক্রমে এর মাত্রা বাড়তে থাকে। উপসর্গগুলোর মধ্যে অল্প অল্প বা বেশি বেশি জ্বর অনুভূত হওয়া, কাশি ও কাশির সাথে কফ বা রক্ত বা উভয়ই যাওয়া, দুর্বলতা বোধ করা ও ক্রমে এর মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, বুকের যে দিকের ফুসফুস আবরণীতে পানি/তরল জমে সে দিকে ব্যথা অনুভূত হওয়া, ক্রমে ও দ্রুত ওজন হ্রাস পাওয়া, অল্প পরিশ্রমে ক্লান্ত বোধ করা, খাদ্যে অরুচি ইত্যাদি অন্যতম। খুব বেশি পরিমাণে পানি/তরল জমার কারণে অনেক সময় শ্বাসকষ্টও অনুভূত হতে পারে। পানি/তরল জমার বিভিন্ন কারণগুলোর মধ্যে শিশু বা যুবকদের মধ্যে যক্ষ্মা অন্যতম প্রধান কারণ। নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু ও বৃদ্ধ বয়সের রোগীদের ফুসফুসের আবরণী পর্দায় অনেক সময় পানি/তরল জমতে পারে। তবে অধিক বয়সে ফুসফুসের আবরণী পর্দায় পানি/তরল জমার অন্যতম প্রধান কারণ ক্যান্সার। অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা আরো অনেক বেশি।
পুরাল ইফিউশান বা ফুসফুসের আবরণী পর্দায় পানি/তরল জমা নির্ণয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। এ রোগের কারণে উপরোল্লিখিত যেসব লক্ষণগুলোর কথা বলা হয়েছে, কোনো রোগীর ক্ষেত্রে তার প্রকাশ ঘটলে রোগীকে একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞর সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেয়া উচিত। বক্ষব্যাধি চিকিৎসক পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ ও রোগের কারণ নির্ণয়ে সক্ষম হয়। সাধারণভাবে একজন বক্ষব্যাধি চিকিৎসক প্রথমে বুকের এক্স-রে ও সাথে রক্তের সাধারণ একটি পরীক্ষা করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুকের এক্স-রের মাধ্যমে পানি/তরলের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। যদি পানি/তরল এর খুব অল্প হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে বুকের আলট্রাসনোগ্রামের সাহায্য নেয়া হয়ে থাকে। এর পর পর্যায়ক্রমে কফ, টিউবারকুলীন টেস্ট, বিশেষ সূচের মাধ্যমে বুক থেকে পানি/তরল বের করে তার সুনির্দিষ্টি পরীক্ষা, বিশেষ সূচের মাধ্যমে আবরণী পর্দার বা পুরাল টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগের কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব পরীক্ষার মাধ্যমেই রোগের কারণ নির্ণয়ে সফল হওয়া যায়। অনেক সময় রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় সম্ভব না হলে ব্রংকোস্কপি ও সিটিস্ক্যানের মতো জটিল ও ব্যয়বহুল পরীক্ষার সহায়তার প্রয়োজন হয়।
পুরাল ইফিউশান রোগের কারণ নির্ণয়ের পর কারণ সাপেক্ষে চিকিৎসককে পানি/তরল বের করে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। পানি/তরল দীর্ঘসময় জমে থাকলে তা পুঁজে পরিণত হয়; রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে। অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদে পানি/তরল জমে থাকলে তা আবরণী পর্দার অংশগুলোকে পুরু ও অপ্রসারণযোগ্য করে তুলতে পারে যা শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। তবে জমে থাকা তরল যদি পুঁজ বা রক্ত হয়ে থাকে কিংবা যদি ক্যান্সারজনিত কারণে পানি/তরল জমে থাকে সে ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে জমানো তরল বের করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়ে থাকে। পানি/তরল বের করে দেয়ার বিভিন্ন পদ্ধতিগত চিকিৎসার পাশাপাশি যে কারণে এ রোগের সৃষ্টি তার চিকিৎসাও দ্রুত শুরু করার মাধ্যমে একজন বক্ষব্যাধি চিকিৎসক রোগটির সমন্বিতভাবে যথাযথ চিকিৎসা প্রদানের প্রয়াস পেয়ে থাকেন। অনেক সময় পুনঃপুনঃ পানি/তরল জমতে পারে। সে ক্ষেত্রে টেট্রাসাইক্লিন বা বিওমাইসিন ইনজেকশন আবরণী পর্দার দুই স্তরের মাঝখানে প্রয়োগ করে স্তর দু’টিকে পরস্পরের সাথে জোড়া লাগানোর মাধ্যমে আপাতত শূন্যস্থানটিকে বিলোপ করা হয়। এর ফলে পানি/তরল বারবার জমার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানটুকু পায় না। কাজেই ফুসফুসের আবরণী পর্দা বা পুরাল পানি/তরল জমা রোগ হলে চিন্তিত হওয়ার বা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ ও ওষুধ সেবন করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায় আপনার সচেতন সিদ্ধান্ত আপনাকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে।
লেখক : জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement