বাংলাদেশে ক্যান্সার ঝুঁকি
- ডা: হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
- ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:২১
বাংলাদেশে বছরে দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হয় ক্যান্সারে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরে এক লাখ আট হাজার ক্যান্সার আক্রান্ত মৃত্যুবরণ করেন। এদের বেশির ভাগই যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অথবা অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা খপ্পরে পড়ে মারা যান। আবার শেষপর্যায়ে এসে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার কারণে কোনো চিকিৎসা কাজ করে না, এমন মানুষ আছে যাদের শেষ পরিণতি মৃত্যু।
গবেষকেরা বলছেন, এশিয়া ও আফ্রিকায় ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বৈশি^ক অনুপাতের চেয়ে বেশি। এ দুই মহাদেশে ফুসফুস ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার ও অন্ত্রের (বোউয়াল) ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা থাকার পরও চলতি বছর বিশ^ব্যাপী এক কোটি (১০ মিলিয়ন) মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। এ ছাড়া নতুন করে আরো এক কোটি ৮১ লাখ (১৮.১ মিলিয়ন) মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি পাঁচজনের একজন পুরুষ এবং প্রতি ছয়জনের একজন মহিলা ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। আইএআরসির গবেষণায় বলা হয়েছে, হঠাৎ ধনী হওয়া দেশগুলোর মানুষের জীবনমানের (লাইফস্টাইল) পরিবর্তনের কারণেই তারা বেশি করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। একটা সময় এসব দেশের মানুষ প্রয়োজনীয় ন্যূনতম খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেত। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিশীলতা এবং দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার কারণে তাদের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে স্ফীত হয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। ফলে তাদের খাদ্যাভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। হঠাৎ করে হাতে অর্থ আসায় বিলাসী খাবারের ভোগ বেড়েছে এবং একই সাথে শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণও কমে গেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হওয়ায় এসব দেশে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে ধূমপান। শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়ায় বেড়েছে স্থূলতা। একই সাথে বিলাসিতার প্রতি ঝুঁকে যাওয়ায় মদপান উচ্চ আয়ের মানুষের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। গবেষকেরা বলছেন, ক্যান্সারের উচ্চ হারে আক্রান্তের সাথে ক্যান্সার নির্ণয় (ডায়াগনসিস), প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও চিকিৎসার দৈন্য রয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়েনি, এমন দেশগুলোর মানুষেরও নানা কারণে ক্যান্সার হচ্ছে। এরা ক্যান্সার নির্ণয়, প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা নিতে পারছে না দারিদ্র্যের কারণে।
আইএআরসির পরিচালক ক্রিস্টোফার ওয়াইল্ড এ বিষয়ক নিবন্ধে বলেন, ‘বিশ^ব্যাপী ক্যান্সার আক্রান্তের হার বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে। আমাদের ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করতে হবে।’
গবেষকেরা জীবনমান পরিবর্তনে ক্যান্সার রোধে কিছু করণীয় ঠিক করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা প্রথম যে পরামর্শ দিয়েছেন তা হলো- ‘তামাক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। তামাক ফুসফুস, মুখ, গলা, ল্যারিংস, অগ্ন্যাশয়, মূত্রথলি, জরায়ু ও কিডনিতে ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী।’ ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার জন্য তারা দ্বিতীয় পরামর্শ দিয়েছেন। তৃতীয় পরামর্শ দিয়েছেন অ্যালকোহল (মদপান) থেকে দূরে থাকতে। তারা জানিয়েছেন, ‘মদপান করলে স্তন, কোলন, ফুসফুস, কিডনি ও যকৃতে ক্যান্সার হয়ে থাকে।’ গবেষকেরা সুঠাম দেহবিশিষ্ট ওজনের অধিকারী হতে এবং কর্মক্ষম থাকতে বলেছেন। সুঠাম দেহ বিভিন্ন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। তারা বলেছেন, সুঠাম দেহ স্তন, কোলন, ফুসফুস, কিডনি ও যকৃত ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করে। ত্বকের ক্যান্সার রোধে বেশিক্ষণ রোদে অবস্থান করা থেকে গবেষকেরা নিরুৎসাহিত করেছেন। তবে তারা এটাও জানিয়েছেন যে, ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। লিভার ক্যান্সার বৃদ্ধি করে থাকে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিতে বলেছেন গবেষকেরা। আবার হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) জরায়ুর ক্যান্সারসহ অন্যান্য জনন অঙ্গ সম্পর্কিত ক্যান্সার এবং হেড-নেক ক্যান্সার বৃদ্ধি করে থাকে। এই ক্যান্সার প্রতিরোধেও রয়েছে ভ্যাকসিন। ত্বক (স্কিন) কোলন, জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে নিজে নিজে নিয়মিত পরীক্ষা করারও পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকেরা।
বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের দুই-তৃতীয়াংশ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে চলে যান। এটা হয়ে থাকে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের ওপর অনাস্থার কারণে। একই সাথে চলে যায় শুধু ক্যান্সারের চিকিৎসায় শত কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রাও। বাংলাদেশে অনানুষ্ঠানিক এক জরিপে দেখা গেছে, ক্যান্সার রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ রোগী দেশের স্বীকৃত চিকিৎসাব্যবস্থার আওতায় আসে। এদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। যারা বিদেশ যেতে পারেন না, তারা নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার আশ্রয় নিচ্ছেন। ফলে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে বিপুল সংখ্যক রোগী।
গত দুই দশকে দেশে সরকারি খাতে ক্যান্সার চিকিৎসার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটেছে লক্ষণীয়ভাবে। ঢাকার মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালকে ৫০ থেকে ৩০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। রেডিওথেরাপির আধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও ঢাকার বাইরে বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপির সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন সংযুক্ত হয়েছে। তবে আগে থেকে চালু আটটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সবগুলোতে বিকিরণ চিকিৎসা চালু নেই।
বেসরকারি খাতে কয়েকটি বড় হাসপাতালে রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সার চিকিৎসা চালু হয়েছে। সর্বশেষ প্রযুক্তির মেশিনও তাদের কাছে রয়েছে। এখানে সচ্ছল রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে বেসরকারি ক্যান্সার চিকিৎসাব্যবস্থা।
জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত ও সরকার স্বীকৃত সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল নির্যাস অর্থাৎ আর্থিক সক্ষমতা নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের রোগ থেকে সুরক্ষা ও চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সুস্থ হওয়ার অধিকার রয়েছে। মৌলিক অধিকার বলে বিনামূল্যে সেবা পাওয়ার অধিকারও মানুষের থাকতে হবে। সব ধরনের সুবিধা না পেলেও সরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে কিছু সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। সরকারিভাবে কেবল মহাখালীতে রয়েছে ৩০০ বেডের একটি হাসপাতাল। এর বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। ঢাকার বাইরে আটটি বিভাগে আটটি আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, এই কেন্দ্রগুলো হওয়া উচিত সমন্বিত। ক্যান্সার প্রতিরোধ, চিকিৎসা, প্রশমন সেবাসহ সব সুবিধা থাকতে হবে এখানে। একই সাথে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সার্জারি, ক্যামোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি সুবিধাও যুক্ত করতে হবে।
ক্যান্সারের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। ডা: হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন জানান, শুরুতে ক্যান্সার শনাক্ত হলে সহজে এবং কম খরচে সুস্থ হওয়া সম্ভব। কিন্তু দেরি হয়ে গেলে পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগে। অনেক সময় সুস্থ হওয়া যায় না। একই সাথে তা খুবই ব্যয়বহুল ও জটিল। কিন্তু কিছু অভ্যাস বর্জন করলে অথবা কিছু অভ্যাস নিজের মধ্যে গড়ে তুললে এমনিতেই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তারা বলছেন, পাঁচটি ঝুঁকি এড়িয়ে চললে এবং পাঁচটি অভ্যাস নিজের মধ্যে গড়ে তুললে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা একই সাথে সাতটি সতর্ক সঙ্কেতের দিকে লক্ষ রাখার পরামর্শও দিয়েছেন ক্যান্সার প্রতিরোধে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা যে পাঁচটি ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে বলেছেন; এগুলোকে এক কথায় ‘না’ বলতে বলেছেন। এগুলো হলো- ধূমপান ও তামাকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ না করা (যেমন- জর্দা, গুল, সাদা পাতা, খৈনি ইত্যাদি); বাল্যবিবাহ থেকে বিরত থাকা; অতিরিক্ত গোশত ও চর্বিজাতীয় খাবার না খাওয়া; অ্যালকোহল বা মদপান না করা এবং একাধিক সঙ্গীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন না করা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা যে পাঁচটি অভ্যাসকে নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে বলেছেন; এগুলো হলো-
সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা (বিশেষ করে মহিলাদের মাসিকের সময়), প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া, দৈনিক হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি করা এবং সর্বশেষটি হলো ৯ থেকে ১৩ বছরের কন্যাসন্তানকে হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসের (এইচপিভি) টিকা দেয়া।
ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সাতটি সতর্ক সঙ্কেতকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। এই সাত সতর্ক সঙ্কেত নিজের মধ্যে দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এগুলো হলো- খুশখুশে কাশি বা ভাঙা কণ্ঠস্বর, সহজে শুকাচ্ছে না এমন শারীরিক ক্ষত, স্তনে বা শরীরের কোথাও চাকা বা পিণ্ড দেখা দিলে, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হলে, শরীরে তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দিলে।
এ পাঁচটি ঝুঁকি, পাঁচটি অভ্যাস গড়া এবং সাতটি সতর্ক সঙ্কেতকে একত্রে ৫৫৭ বলে বলে অভিহিত করা হয়েছে।
মহাখালীর ক্যান্সার হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও স্বল্পমূল্যে ক্যান্সার চিকিৎসা হয় না। এর বাইরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন রয়েছে। এ ছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়েও ক্যান্সার চিকিৎসা হয়। কিন্তু প্রতি এক লাখ ৫০ হাজার নতুন ক্যান্সার রোগীর জন্য এই হাসপাতালের সেবা পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে অনেক রোগী দেশের বাইরে চলে যায়।
লেখক : মহাখালীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতালে এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান এবং সহযোগী অধ্যাপক