০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৪ পৌষ ১৪৩১, ৭ রজব ১৪৪৬
`

প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করছে

দূষিত প্লাস্টিক বোতল নিয়ে কাজ করছেন এক পরিচ্ছন্ন কর্মী। ইনসেটে লেখক। - ছবি : লেখক।

প্লাস্টিকের তৈরি জিনিস মানুষের জীবনকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেছে। ঘরে-বাইরে এখন দেদার ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিকের বোতল। শিশু সন্তানের স্কুলে পানি নেওয়া থেকে শুরু করে অফিস, আদালতে কিংবা ঘুরতে যাওয়ার সময়ে পানি পান করার জন্য ব্যাগে ভরে নেওয়া হয় প্লাস্টিকের বোতলে পানি। অনেকে আবার কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল ধুয়ে তাতে পানি ভরে মাসের পর মাস দিব্যি পান করছেন। কখনও ভেবে দেখেছেন, তা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই প্লাস্টিকের বোতলে দিনের পর দিন পানি পান ডেকে আনতে পারে বড় বিপদ। ক্ষতিকর প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় থেকে সাবধান। যার ফলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে শরীরের। দেখা দিতে পারে দুরারোগ্য ব্যাধিও।

সম্প্রতি আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, প্লাস্টিকের বোতলে লাখ লাখ প্লাস্টিক-কণা পানির সাথে মিশে থাকে। এই প্লাস্টিক পানি পান করার সময় শরীরে ঢোকে এবং শরীরে টক্সিনের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বেশি মাত্রায় এই প্লাস্টিকের কণা শরীরে ঢুকলে তা শরীরে ইনসুলিনের তারতম্য ঘটায়। টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।

প্লাস্টিক বোতল ব্যবহারের ফলে আমাদের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বছরে ৩.১৫ বিলিয়ন থেকে ৩.৮৪ বিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে মাত্র ২১.৪ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়, বাকি ৭৮.৬ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণ সৃষ্টি করছে।

প্লাস্টিক বোতল পরিবেশে ৪৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে এবং এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এটি মাইক্রোপ্লাস্টিক ও বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে। এই বিষয়টি এখন একটি বড় স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত সংকট হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ন্যানোপ্লাস্টিক ও ‘বিসফেনল এ’ যদি বেশি মাত্রায় মানুষের শরীরে ঢোকে, তা হলে তা বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কী কী রোগ হতে পারে, সেই নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়েই গবেষকেরা দেখেছেন, বোতল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন কয়েক ধরনের প্লাস্টিক শরীরে ইনসুলিনের ক্ষরণে প্রভাব ফেলে। যা পরবর্তী সময়ে ডায়াবিটিসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ৪০ জন প্রাপ্তবয়স্কের উপর পরীক্ষা করে এমন প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি গবেষকদের। শুধু তা-ই নয়, প্লাস্টিকের ‘বিপিএ’ হরমোন ও ক্রোমোজোম ঘটিত সমস্যাও ডেকে আনতে পারে। অধিক মাত্রায় প্লাস্টিক-কণা শরীরে জমলে পুরুষদের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর পরিমাণ কমিয়ে দেয়। মহিলাদের হরমোন ক্ষরণে বাধা তৈরি করে। বিশেষ করে, ইস্ট্রোজেন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।দেশের ৮৩.৬ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করেন।কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১৮.৪ শতাংশ শহরবাসী এবং ৫.৫ শতাংশ গ্রামবাসী প্লাস্টিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন। অধিকাংশ মানুষ একবার ব্যবহার করে প্লাস্টিক বোতল ফেলে দেন যা পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লাস্টিক দূষণ, বিশেষত একবার ব্যবহারযোগ্য বোতল থেকে সৃষ্টি হওয়া দূষণ, আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি উদ্বেগজনক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।গবেষকদের মতে, এই প্লাস্টিক বোতল থেকে বিসফেনল ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের মতো রাসায়নিক আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে যা মানবস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে।

প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার কমিয়ে আনা, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহার বাড়ানো এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

পরিবেশবান্ধব সাশ্রয়ী বিকল্প ব্যবহার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বোতল ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা, প্লাস্টিক বোতল উৎপাদন ও ব্যবহার কমানোর জন্য কঠোর নীতিমালা গ্রহণের কথা বলছেন অনেকে। এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ওপর বাড়তে থাকা এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

লেখক: পাবলিক রিলেশন অ্যান্ড মার্কেটিং স্পেশালিস্ট, ক্রিলিক-এলজিইডি


আরো সংবাদ



premium cement