২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়

-

রাগ কমান, কমিয়ে ফেলুন মানসিক চাপ। জোর করে হলেও হাসুন প্রান খুলে। মেডিটেশন করতে পারেন। এত কমবে মানসিক চাপ, বাড়বে আত্মবিশ্বাস

স্ট্রোক একটি ঘাতক ব্যাধি। প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা যান অর্ধ কোটি মানুষ আর অর্ধ কোটি পঙ্গুত্ব বরণ করেন। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ এটি। মারা যাওয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ আমাদের মতো দেশে ঘটে। দিন দিন স্ট্রোক আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার প্রায় ৮০ গুণ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশেও এ হার কিন্তু কম নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি ১ হাজার জনে প্রায় ১২ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। ঘাতক এ ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকতে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করা হয়। এবারও তা পালিত হবে। স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি অসুখ। মস্তিষ্কের রক্তনালীর রোগ এটি। স্ট্রোক দুই ধরনের।
১. ইসকেমিক স্ট্রোক
২. হেমোরেজিক স্ট্রোক
ইসকেমিক স্ট্রোক- মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যায়। ফলে মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। শুরুতে কোষগুলো রক্ত চলাচল কমে গেলেও বেঁচে থাকতে পারে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর কোষগুলো মারা যায়। একে বলে কোর। কোরের চার পাশে মস্তিষ্কের বেশ কিছু অংশেও রক্ত কমে যায়। একে বলে প্যানামব্রা। যদি প্যানামব্রা অংশে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা যায় তা হলে স্ট্রোকের ভয়াবহতা অনেকটা কমানো যায়।
হেমোরেজিক স্ট্রোক - মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।
কারণ কি?
সম্প্রতি ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের ৩২টি দেশের মানুষকে নিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে বলা হয়েছে, মাত্র ১০ টি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। তাদের মতে এ ১০টি কারণ হলো-
১. উচ্চ রক্তচাপ, ২. ডায়াবেটিস, ৩. রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, ৪. স্থুলতা, ৫. ধূমপান, ৬. মদপান, ৭. হার্টের রোগ, ৮. শারীরিক পরিশ্রম না করা, ৯. মানসিক অবসাদ, ১০. সঠিক খাদ্যাভ্যাস না মানা।
এ কারণগুলো কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আরও কিছু কারণ আছে যেগুলোর জন্যও স্ট্রোক হতে পারে। যেমন বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে, পুরুষদের ঝুঁকি বেশি, বংশে কাছের আত্মীয়দের স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। রক্তনালীর সমস্যা যেমন রক্তনালীতে ফোস্কা বা এনিউরিজম বা এভিএম বা রক্তনালী অস্বাভাবিক কমিউনিকেশনের জন্যও স্ট্রোক হতে পারে।
স্ট্রোকের আছে চিকিৎসা
হার্ট অ্যাটাক হলে আমরা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেই। হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীতে রক্ত জমে গেলে হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি নষ্ট হয়ে যায়। একেই বলে হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত নিশ্চিত হওয়ার পর চিকিৎসক হার্টের রক্তনালীতে জমাটবাঁধা রক্ত গলিয়ে ফেলতে এক ধরনের ওষুধ শিরাপথে দিয়ে থাকেন। একে বলে স্ট্রেপ্টোটোকাইনেজ।
একই রকমভাবে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে জমাট বাঁধা রক্ত গলিয়ে ফেলতে একধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। মস্তিষ্কের স্ট্রোকে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তাকে বলে এল্টিপ্লেজ।
যাদের রক্তনালী রক্ত জমে বন্ধ হয়ে যায় যাকে ইস্কেমিক স্ট্রোক বলে। তাদেরকে এল্টিপ্লেজ দেয়া যায়।
মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি- স্ট্রোকে অত্যাধুনিক চিকিৎসা
ইস্কেমিক স্ট্রোকের রোগী সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে আসলে তাদের এল্টিপ্লেজ দিয়ে আইভি থ্রম্বোলাইসিস করা যায়। কিন্তু এ সময়ের পরে আসলে কি আর চিকিৎসা নেই? না, চিকিৎসা আছে। স্ট্রোকের ৬ ঘণ্টার মধ্যে আসলে অত্যাধুনিক চিকিৎসা করা সম্ভব। এর নাম হলো মেকানিক্যাল থ্রোম্বেক্টমি। রোগীকে ক্যাথল্যাবে নিয়ে গিয়ে হার্টের এনজিওগ্রামের মতো ব্রেনের এনজিওগ্রাম করা হয়। যদি তাতে দেখা যায় মস্তিষ্কের মোটা রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধেছে তা হলে একটি বিশেষ সাহায্যে জমাট বাঁধা রক্ত টেনে বের করে আনা হয়। ফলে বন্ধ রক্তনালী খুলে যায়। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। শতকরা ৭০ ভাগ রোগী এতে সুস্থ হয়ে যান। আমাদের দেশেও এ চিকিৎসা অল্প-বিস্তর হচ্ছে।
স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়
শতকরা ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। স্ট্রোকের মূল কারণগুলো প্রতিরোধ করতে পারলে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়।
ধূমপান ও মদপান পরিহার করুন : গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ধূমপানের ফলে রক্তনালীতে চর্বি জমা হয়ে রক্তনালী বন্ধ করে দেয়। ফলে মস্তিষ্কে পরিমিত রক্ত পৌঁছতে পারে না। সিগারেটের নিকোটিন রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, রক্তে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় ও রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে রক্তপিণ্ড তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। যে কোনো বয়সেই ধূমপান ত্যাগ করা হোক না কেন তা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
নিয়ন্ত্রণ করুন উচ্চ রক্তচাপ : রক্তচাপ স্বাভাবিকের মধ্যে রাখুন। এ জন্য অতিরিক্ত লবণ পরিহার করুন, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন।
হার্টের রোগের চিকিৎসা নিন : হার্ট অ্যাটাক, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, হার্ট বড় হয়ে গেলে, ভাল্বের সমস্যা ইত্যাদি কারণে রক্তজমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। তাই এ রোগগুলোর চিকিৎসা করান। রক্তজমাট বাধা প্রতিরোধে আপনাকে অ্যাসপিরিন খেতে হতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিবেন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন : ডায়াবেটিসে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রোকের সময় রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকলে মস্তিষ্কে কোষ বেশি পরিমাণে ধ্বংস হয়। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের কারণে রক্তনালীতে চর্বি জমে যায়। ফলে রক্তনালী সরু হয়ে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। চিকিৎসকের পরামর্শে পরিমাণ মতো খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন আর শৃঙ্খলা মেনে চলুন, মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খান ও নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
পুষ্টিকর খাবার খান : প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খান। প্রতি দিনের খাবারে পাঁচ ভাগের এক ভাগ ফলমূল ও শাকসবজি খান। রেড মিট যেমন, গরু, ছাগল, ভেড়ার গোশত খাবেন না। চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এতে বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যেটা ধমনিতে চর্বির আস্তরণ পড়তে সহায়তা করে। লবণ রক্তচাপ বাড়ায়। লবণ খাবেন না। আঁশযুক্ত খাবার বেশি বেশি করে খান। কমিয়ে ফেলুন শরীরের অতিরিক্ত ওজন। অতিরিক্ত খাবার খাবেন না। এতে শরীরে মেদ জমবে। খাবার খান শারীরিক পরিশ্রমের সাথে মিল রেখে। পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন সবুজ শাকসবজি, সয়াবিন তেল, মাছের যকৃত খান।
ব্যায়াম করুন : গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৫ ব্যায়াম করে তাদের রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। হাঁটা ভালো ব্যায়াম। হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতি দিন একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে হাঁটুন। সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ মাইল হাঁটুন। এ ছাড়া সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, নাচা, টেনিস, গলফ খেলতে পারেন। ব্যায়ামের সময় বুকে ব্যথা, মাথা ঝিম ঝিম ও শ্বাসকষ্ট হলে ব্যায়াম বন্ধ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মানসিক চাপ কমান : রাগ কমান, কমিয়ে ফেলুন মানসিক চাপ। জোর করে হলেও হাঁসুন প্রাণ খুলে। মেডিটেশন করতে পারেন। এতে কমবে মানসিক চাপ, বাড়বে আত্মবিশ্বাস।
রক্তে কোলেস্টেরল কমিয়ে ফেলুন : রক্তে কোলেস্টেরল বেশি হলে রক্তনালীতে চর্বি জমে রক্তনালী বন্ধ হয়। নিয়ন্ত্রণে রাখুন কোলেস্টেরলের মাত্রা। তাই স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার যেমন গরু বা খাসি বা পাতিহাঁস, শুকুরের মাংস, চিজ, বিভিন্ন ধরনের কেক, আইসক্রিম, ইয়োগাট, কনডেন্সড মিল্ক ও কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার ডিমের কুসুম, চুপড়ি আলু, বিভিন্ন প্রাণীর মস্তিষ্ক ও যকৃত, চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। যদি রক্তে কোলেস্টেরল না কমে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে হবে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল : পিল রক্তকে ঘন ও জমাট বেঁধে ফেলতে পারে। সেই সাথে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। পিল সেবনের আগে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
লেখক : স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস)


আরো সংবাদ



premium cement