২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইউরিক এসিড সম্পর্কে জানুন

ইউরিক এসিড সম্পর্কে জানুন -

মানব দেহে খাবার গ্রহণের পর তা পরিপাক হয়ে বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়। এই বর্জ্য পদার্থ প্রতিনিয়ত দেহ থেকে নানা মাধ্যমে বের হয়ে যায়। যদি বর্জ্য পদার্থ বের না হয়ে ভেঙে রক্তে জমা হয় বা দেহে জমা হয় তাহলে শরীরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বা সমস্যা তৈরি করে। ফলে পরবর্তীতে দেহে রোগ দেখা দেয়। ঠিক তেমনি রক্তের একটি বর্জ্য পদার্থ হলো ইউরিক এসিড। যার মাত্রা রক্তে গেলে নানা সমসার সৃষ্টি করে।
ইউরিক এসিড কী : ইউরিক অ্যাসিড হলো পিউরিন নিউক্লিওটাইডের বিপাকিড ভাঙ্গনের ফলে তৈরি দ্রব্য এবং মূত্রের একটি সাধারণ উপাদান।
কেন হয় : মানব দেহে নাইট্রোজেনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ হয় আমিজজাতীয় খাবার থেকে। এসব আমিষজাতীয় খাবার বিপাকের ফলে শরীরে তৈরি হয় পিউরিন। এই পিউরিন পরিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় ইউরিক এসিডে। শরীরে তৈরি হওয়া ইউরিক এসিড বেশি ভাগ কিডনির মাধ্যমে নিঃসরিত হয়ে প্রস্রাবের মাধ্যমে এবং বাকিটা পায়খানার মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। পিউরিন থেকে ইউরিক এসিড তৈরি এবং দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটা সমতা থাকে। ফলে শরীরে ইউরিক এসিডে মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। কোনো কারণে ইউরিক এসিড তৈরির হার যদি বেড়ে যায় বা শরীর থেকে নিঃস্বরণ কমে যায় তাহলে রক্তে এর মাত্রা বাড়তে থাকে। এ অবস্থাকে বলা হয় হাইপারইউরিসেমিয়া। শরীরে দীর্ঘদিন উচ্চমাত্রার ইউরিক এসিড থাকলে এগুলো সূক্ষ্ম স্ফটিক আকারে দেহের অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ায় জমা হয়ে ব্যথার সৃষ্টি করে। প্রথমে শুধু পায়ে ব্যথা হয় পরে আস্তে আস্তে এর তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে হাঁটুতে ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, পা ফোলা ও লাল হয়ে ওঠা এবং উঠলে বসতে অসুবিধা, বসলে উঠতে অসুবিধা, ও হাঁটতেও সমস্যা দেখা দেয়। তাছাড়া শরীরে বাত, কিউনিতে পাথর, উচ্চরক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে।
রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা : আমাদের শরীরে এই ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা রয়েছে। পুরুষের ক্ষেত্রে ৩.৪ থেকে ৭.০০ মিলিগ্রাম পার ডিএল (ডেসিলিটার)। মহিলাদের ক্ষেত্রে ২.৪ থেকে ৬.০ মিলিগ্রাম পার ডিএল (ডেসিলিটার) উল্লেখিত মাত্রা স্বাভাবিক। এর চেয়ে কমবেশি হলেই শরীরে সমস্যার সৃষ্টি করে।
যেভাবে বুঝবেন : শরীরে ইউরিক এসিডের মাত্রা বাড়লে নানা সমস্যা দেখা দেয়। নিজেই অনুভব করা যায় দেহের হাড়ের জোড়াগুলোতে ব্যথা করে, ফুলে যায়, বিশেষ করে পায়ের আস্ত আঙুলে বা হাঁটতে ব্যথা হয়। বারবার প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। কারণ কিডনি চায় শরীরের অতিরিক্ত ইউরিক এসিড বের করে দিতে এবং বের করতে না পারলে সমস্যা দেখা দেয়। উচ্চ মাত্রা দেখা দিলে কিউনিতে পাথর হতে পারে। ফলে প্রস্রাব করার সমস্যা দেখা দেয়। কোনো সময় শরীরে ব্যথা দেখা দিতে পারে বিশেষ করে পিঠে ব্যথা হতে পারে। প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া হতে পারে। এমন অবস্থা বুঝতে পারলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
কারা ইউরিক এসিডে বেশি আক্রান্ত হন : খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন না হলে নিজের অজান্তেই অনেক রোগ বাসা বাঁধে। নি¤œলিখিত ব্যাপারে যারা সচেতন নয় তারাই বেশি আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে।
ষ এলকোহল (মদ) গ্রহণ করেন। ষ যারা আশিষজাতীয় খাবার দেহের চাহিদার তুলনায় বেশি খান এবং শাকসবজি কম খান। ষ যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যা আছে। ষ যাদের শারীরিক ওজন বেশি। ষ যারা পানি পান কম করেন। ষ চিকিৎসকদের মতে, কিছু কিছু ওষুধ রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যেমন ডাইইউরেটিক মেডিসিন, যারা পিউরিনসমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত গ্রহণ করেন এবং ভিটামিন সি-জাতীয় খাবার বা ফলমূল কম খান।
প্রতিরোধ : ইউরিক এসিডের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা মোতাবেক খাবার গ্রহণ করা এবং নিয়মিত ব্যয়াম করা। উচ্চ পিউরিনযুক্ত খাবার বাদ দিয়ে চলা। কোমলপানীয় ও মদজাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে একজন রেজিস্ট্রার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। তাছাড়া নিত্যদিনের খাবার তালিকা হতে কিছু খাবার বাদ দেওয়া। নি¤েœ যেসব খাবার গ্রহণ ও বর্জন করতে হবে তা তুলে ধরা হলো :
যেসব খাবার বর্জন করতে হবে : সামদ্রিক মাছ, খাসির গোশত, হাঁস, ভেড়ার গোশত, কলিজা, মগজ, ফুসফুস গুর্দা, মুরগির চামড়া, চিংড়ি, শুঁটকি, ইলিশ, মাছের ডিম, টুনা মাছ, প্রাণীজ চর্বি ইত্যাদি। উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যেসব খাবার বাদ দিতে হবে : পালংশাক, শিম, পুঁইশাক, শিমের বীচি, মটরশুঁটি, বেগুন, বরবটি, ডাল, ফুলকপি, মাশরুম, কৃত্রিম ফলের রস, চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, তিল, মুলাশাক, মুলা, ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, বিট, টমেটো, কাঁঠালের বীচি, তেলেভাজা খাবার ইত্যাদি।
যেসব খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে : যেহেতু এ রোগে আক্রান্ত রোগীকে আমিষজাতীয় খাবার গ্রহণে বর্জ্য করতে বলা হয় তাই সারা দিনের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে মিঠা পানির মাছ, ডিমের সাদা অংশ, টকদই, দুধ গ্রহণ করা যেতে পারে। লালশাক, ডাঁটাশাক, সরিষা শাক, লাউ শাক, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, পটোল, বীচি ছাড়া করলা, সবুজ আপেল, নাশপাতি, পাকা পেঁপে, পাকা বেল, লেবু, আমড়া, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি। এছাড়া আনারস, চেরি, জাম হলুদ খেতে পারেন। আনারসে ব্রোমেলিন নামে এক ধরনের এনজাইম থাকে যা হাড়ের জোড়ার ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। তবে গর্ভবতী মহিলারা আনারস খাবেন না।
উপসংহার : শারীরিক সমস্যার উপরোক্ত লক্ষণ হলেই যে ইউরিক এসিড বেড়েছে তা নাও হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ও পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হবেন না। অবশ্যই চিকিৎসকের ও একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেবেন এবং চলবেন। নিজে নিজে কোনো ওষুধ খাবেন না। সতর্ক হন, সচেতন হন, ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণ করুন, সুস্থ থাকুন।
লেখক : শিক্ষক, ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, গোলাপগঞ্জ, সিলেট


আরো সংবাদ



premium cement