০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১,
`

সাফ জয়ী বাংলাদেশী তারকাদের কথা

- ছবি : সংগৃহীত

গত ৩০ অক্টোবর নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৪ এর ফাইনালে নেপালকে ২-১ গোলে পরাজিত করেছে বাংলাদেশ। এটি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের মেয়েদের দ্বিতীয়বারের মতো সাফ জয়। এর আগে ২০২২-এর ১৯ সেপ্টেম্বর শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে একই ভেন্যুতে একই দলকে ৩-১ গোলে পরাস্ত করেছিলেন বাংলার বাঘিনীরা।

এবারের আসরে গ্রুপ পর্বের ৩ খেলায় একটি জয় ও একটি ড্র নিয়ে সেমিফাইনালে যায় বাংলাদেশ। সেখানে ভুটানকে ৭-১-এর বিরাট ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। তারপর কাঙ্ক্ষিত শিরোপা জয় লাল-সবুজের পতাকাবাহীদের।

চলুন, তাদের মধ্যে সেরা কয়েকজন নারী ফুটবল তারকার কথা জেনে নেওয়া যাক।

২০২৪ সাফ নারী ফুটবল শিরোপা জয়ী বাংলাদেশি তারকারা

ঋতুপর্ণা চাকমা

২০০৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির কাউখালীতে জন্ম ঋতুপর্ণার। ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই খেলে আসছেন মিডফিল্ডার হিসেবে। সাফের এবারের আসরের চূড়ান্ত পর্বের খেলায় ৮১-তম মিনিটে তার গোলটিই বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দেয়।

মাঠের বামপ্রান্ত দিয়ে ডি-বক্সের বাইরে থেকে তার হাওয়ায় ভাসানো শটটি ছিল দুর্দান্ত। আপ্রাণ চেষ্টার পরেও তা ধরতে পারেননি নেপালের গোলরক্ষক আনজিলা তুম্বাপো। তার হাত ছুঁয়ে ক্রসবারে লেগে গোললাইনে গন্তব্য খুঁজে নেয় ঋতুপর্ণার শট। এই মোড় ঘোরানো পারফর্মেন্সের জন্য তাকে ম্যাচের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৭ গোলের বিধ্বংসী পারফর্মেন্সেও একটি গোল রয়েছে ঋতুপর্ণার। ২০২২-এর সাফ তথা গতবারের মতো এবারও তার সংগ্রহে মোট গোলসংখ্যা দুইটি।

রুপনা চাকমা

দলের দুর্গসম গোলরক্ষক রুপনা চাকমার জন্ম ২০০৪ সালের ২ জানুয়ারি। তার নিবাস রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের ঘিলাছড়ি পাহাড়ে অবস্থিত ভূইয়োদম গ্রাম। এবারের সাফে তিনি টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষকের খেতাব পেয়েছেন। এ নিয়ে পরপর দু’বার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা গোলরক্ষের ট্যাগ যুক্ত হলো তার নামের সাথে।

বর্তমান টুর্নামেন্টে মাত্র চারটি গোল রুপনার প্রহরা এড়াতে সক্ষম হয়েছে। ফাইনালে কয়েকটি শট তার হাত ফসকালেও দলের জন্য সেগুলো খুব একটা বিপর্যয় হয়ে আসেনি। বরং সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো অবস্থান নিয়ে বেশ কিছু বড় বড় গোল বাঁচিয়েছেন তিনি। বিগত টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার প্রতিপক্ষের আক্রমণগুলো যথেষ্ট বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করেছেন। যার কারণে শট নেয়ার জন্য প্রতিপক্ষ অধিকাংশ সময় খুব একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে ছিল না।

বিগত সাফে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে তার দৃঢ় প্রহরা ভেদ করে শুধু একবার (ফাইনালে) বল জালে প্রবেশ করেছিল। তার আগের চারটি ম্যাচেই তিনি ছিলেন দুর্ভেদ্য, যা স্বভাবতই এবারের প্রতিপক্ষদের বার বার দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

সাবিনা খাতুন

দলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ এবং অধিনায়ক সাবিনার জন্ম ১৯৯৩-এর ২৫ অক্টোবর খুলনার সাতক্ষীরায়।

ফরোয়ার্ডে খেলা এই ফুটবলার এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে সর্বোচ্চ সংখ্যক গোলদাতা। এবারের টুর্নামেন্টে তিনি মোট তিনটি গোল করেছেন।

এর আগের সাফে সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের খেতাবটি যুক্ত হয়েছিল তার নামের সাথে। তাছাড়া তিনি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরারও (৮ গোল) হয়েছিলেন।

তহুরা খাতুন

ময়মনসিংহের কলসিন্দুর নিবাসী তহুরার জন্ম ২০০৩ সালের ৫ মে। দলের প্রতিভাবান এই ফরোয়ার্ড এবার সেমিফাইনালে ভূটানের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। গোটা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ১৩টি গোলের মধ্যে তার গোল সংখ্যা ৫টি।

পূর্বে ২০১৬-এর এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গালস রিজিওনাল (সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল) চ্যাম্পিয়নশিপের সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড ছিল তার দখলে। সেখানে ফাইনালে হ্যাটট্রিকসহ মাত্র ৪ ম্যাচে মোট ১০টি গোল করেছিলেন তিনি।

২০১৭ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধনী ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে তার একটি হ্যাটট্রিক আছে। এছাড়া ২০১৮ সালের চার জাতি টুর্নামেন্ট জকি সিজিআই অনূর্ধ্ব-১৫’তে তিনি ৩ ম্যাচে ৮ গোল করে সর্বোচ্চ স্কোর অর্জন করেন।

মাসুরা পারভিন

সেন্টার ব্যাকে খেলা সাতক্ষীরার মেয়ে মাসুরার জন্ম ২০০১-এর ১৭ অক্টোবর। এখন পর্যন্ত ফুটবল ক্যারিয়ারে খুব কমই গোলের দেখা পেয়েছেন মাসুরা। তবে ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ সাফে নেপালের বিপক্ষে চরম সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ দলের। এমন জরুরি অবস্থায় মাসুরার একটি গোল যেন সোনার হরিণ পাইয়ে দিয়েছিল সাবিনাদের। এই একটি গোল নিয়েই সেবার জয় পায় বাংলার বাঘিনীরা।

মনিকা চাকমা

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ির অন্তর্গত সুমন্তপাড়া গ্রামের মেয়ে মনিকা খেলেন মিডফিল্ডার হয়ে। তার জন্ম ২০০৩-এর ১৫ সেপ্টেম্বর।

২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের বাংলাদেশ বনাম মঙ্গোলিয়ার সেমিফাইনালটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল থাইল্যান্ডে। সেখানে মঙ্গোলিয়া ৩-০ ব্যবধানে বাংলাদেশের কাছে হেরে যায়। এই ৩টি গোলের মধ্যে একটি ছিল মনিকার, যেটি ফিফা ‘জাদুকরী গোল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই সাথে মনিকার নামের সাথে যুক্ত হয়েছিল ‘ম্যাজিকাল চাকমা’ উপাধিটি। বিশ্ব ফুটবলের শীর্ষ সংস্থাটির ওয়েবসাইটে সেরা গোলগুলোর তালিকায় যুক্ত আছে এই নজরকাড়া পারফর্মেন্সটি।

২০২৪-এর সাফে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে পুরো প্রথমার্ধটাই ছিল গোলশূন্য। অতঃপর দ্বিতীয়ার্ধের সূচনা হয় মনিকার গোল দিয়ে, যা গোটা দলের জন্য অনেকটা স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিল।

মারিয়া মান্দা

মিডফিল্ডার মারিয়ার জন্ম ২০০৩ সালের ১০ মে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার মন্দিরঘোনা গ্রামে। সাবিনার মতো এই ফুটবলারেরও রয়েছে নেতৃত্বের গুণাবলি। বাংলাদেশ তার সহ-অধিনায়কত্বে তাজিকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল। ২০১৭ সালে তার অধিনায়কত্বে গোটা অনূর্ধ্ব-১৫ সাফে অপরাজেয় হিসেবে ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ দল। অতঃপর জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে ভারতকে হারিয়ে তারা শিরোপা নিশ্চিত করে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ কোয়ালিফায়ারেও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দলের সহঅধিনায়ক ছিলেন মারিয়া। এমনকি অনূর্ধ্ব-১৮ সাফেও তার দল ছিল অপ্রতিরোধ্য। অনূর্ধ্ব-১৯-এও তিনি অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু সেবার একটানা শিরোপা জয়ে বাধা পড়ে।

শামসুন্নাহার সিনিয়র

ময়মনসিংহের কলসিন্দুর থেকে আগত প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের মধ্যে শামসুন্নাহার নামে রয়েছেন দু’জন। তন্মধ্যে শামসুন্নাহার সিনিয়র খেলেন ডিফেন্ডার হিসেবে, যার জন্ম ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পজিশনে খেললেও শেষ পর্যন্ত লেফ্ট-ব্যাকেই তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দক্ষিণ রাণীপুর গ্রাম নিবাসী এই ফুটবলার ২০২২-এর সাফে ডিফেন্ডে নিজের জাত চিনিয়েছেন।

শামসুন্নাহার জুনিয়র

অপর শামসুন্নাহারের জন্ম ২০০৪-এর ৩০ মার্চ কলসিন্দুরের মুক্তাগাছা গ্রামে। তিনি সর্বদাই খেলেন ফরওয়ার্ডে। এবারের সাফ টুর্নামেন্টের বাংলাদেশের প্রথম গোলটি আসে তার পক্ষ থেকে।

২০২৩ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেখানে মোট চার ম্যাচে তার সংগ্রহ এক হ্যাটট্রিকসহ মোট পাঁচটি গোল। এই অবদানের জন্য তিনি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পান।

পূর্বে ২০১৮’তে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত জকি ক্লাব চার জাতি টুর্নামেন্টেও তিনি সেরা খেলোয়াড় মনোনীত হয়েছিলেন।

সানজিদা আক্তার

কলসিন্দুর নিবাসী সানজিদার জন্ম ২০০১ সালের ২০ মার্চ। এই মিডফিল্ডার অর্থনীতি বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করছেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে।

২০১৯ সালে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপে তিনি টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জিতেন। খেলাধুলার বাইরে তাকে দেখা গেছে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনে। মিডিয়া পাড়ায় তিনি বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের পোস্টার গার্ল হিসেবে পরিচিত।

শেষাংশ

সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২৪ বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পথে এক সফল অগ্রযাত্রা। যে পথে হেটে দেখালেন ঋতুপর্ণা, রুপনা, সাবিনা, তহুরা, সানজিদা, মারিয়া, মনিকা, মাসুরা, এবং শামসুন্নাহার সিনিয়র ও জুনিয়র প্রত্যেকেই স্বনৈপূণ্যে উজ্জ্বল। তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন নতুন এক বাংলাদেশের। চিত্তাকর্ষক এই ফলাফলের নেপথ্যের যাত্রাপথ খুব একটা ফুলেল ছিল না বৈকি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী; সেই সাথে একজন নারী হওয়াটা কোনোভাবেই প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তাদের সামনে। বরং যোগ্যতা ও ফুটবলের প্রতি অদম্য আবেগের বলে নিজেদের দেশকে তারা পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের সম্মানজনক পর্যায়ে।

 সূত্র : ইউএনবি 


আরো সংবাদ



premium cement