১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি

উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়া সত্ত্বেও আদানির সাথে অসম চুক্তি

-

দেশে গড়ে ১৩ হাজারের বেশি বিদ্যুতের চাহিদা নেই। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে ২৭ হাজার মেগাওয়াট। এর পরেও ভারতের আদানী গ্রুপের সাথে দেশের স্বার্থবিরোধী অসম চুক্তি করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। আর এ চুক্তির বিরুদ্ধে কেউ যেন আদালতে যেতে না পারে সেজন্য দায়মুক্তি আইনের মাধ্যমে এ চুক্তি করা হয়। দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ২৫ বছরের এ চুক্তির মাধ্যমে আদানীকে বাংলাদেশ থেকে বাড়তি পৌনে চার লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। আর বিদ্যুৎ না নিয়েই ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেশকে ২৫ বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকার ওপরে পরিশোধ করতে হবে।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করতে হলে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে হওয়ার কথা। কিন্তু আদানীর সাথে যে চুক্তি করা হয়েছিল সে সম্পর্কে দেশের জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা করা হয়নি। দেশের জনগণের কোনো মতামত নেয়া হয়নি। অথচ কিসের ভিত্তিতে এ চুক্তি করা হয়েছিল তা আজও বোধগম্য নয়। কী চুক্তি করা হয়েছিল, শর্তই বা কী ছিল তা দেশের জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়। বিদেশী গণমাধ্যমের মাধ্যমে শুধু যেটুকু জানা যায়, তাতে এ চুক্তিটি সম্পূর্ণই দেশবিরোধী। ভারতকে খুশি রাখার মাধ্যমে হাসিনা তার চেয়ারকে আজীবন ধরে রাখার জন্য এ চুক্তি করে। দেশবিরোধী এ চুক্তির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ভারতীয় কোম্পানিকে দেয়া হচ্ছে। এজন্য হাসিনা, তার প্রতি মন্ত্রী নসরুল হামিদ ও ওই সময়ে বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্ট আমলাদের কঠোর বিচার হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। একই সাথে এ গণবিরোধী চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে চাহিদার চেয়ে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রিজার্ভ থাকে। বর্তমান চাহিদা গড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। সে অনুযায়ী বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট করা হয়েছে।

অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে সক্ষমতা ইতোমধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রতি বছর ২৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ ভর্তুকি কমাতে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। গত দুই মাসে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এমনি পরিস্থিতি বাড়তি মূল্য ভারতীয় কোম্পানি আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। আদানীর সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা উচিত। কারণ, ২৫ বছরে আদানী শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই নেবে আড়াই লাখ কোটি টাকার ওপরে। আর তেলের দাম ও ডলারের দাম বেড়ে গেলে ক্যাপাসিটি চার্জও বেড়ে যাবে। এমনি পরিস্থিতিতে আদানীর কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা মোটেও ঠিক হবে না। এতে জনদুর্ভোগ আরো বাড়বে। বেড়ে যাবে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ।

আদানির সাথে পিডিবির করা চুক্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুরো চুক্তিই এমনভাবে সাজানো, যাতে আদানি গ্রুপ সুবিধা পায়। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি ৩ মাস পর কত বিদ্যুৎ নেবে, তা আগেই ঘোষণা করতে হবে। যদি বাংলাদেশ এর চেয়ে কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলেও ঘোষিত পরিমাণের সমান দাম পরিশোধ করতে হবে। অথচ বাংলাদেশে যেসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেগুলোর কাছ থেকে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু বিদ্যুৎ নেয় পিডিবি। এ জন্য তিন মাস আগে চাহিদাও পাঠাতে হয় না।

চুক্তি অনুযায়ী, আদানি ইচ্ছা করলেই তৃতীয় পক্ষের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে। তৃতীয় পক্ষের কাছে কেন্দ্রটি যদি বেশি দাম পায়, তাহলে তারা সেখানে বিদ্যুৎ বিক্রি করে দিলে ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতে বিদ্যুৎ বেশি প্রয়োজন হয় গ্রীষ্মকালে। এখন আদানি যদি গ্রীষ্মে ভারতে বিদ্যুৎ দেয় আর শীতে বাংলাদেশকে দেয়, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে না।

প্রসঙ্গত, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত ১২ আগস্ট তাদের বিদ্যুৎ ক্রয়ের নীতিমালায় পরিবর্তন আনে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভারতের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো আদানির গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ কিনতে পারবে।

আদানির কেন্দ্রটি ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াটের স্থাপিত ক্ষমতার। চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে পিডিবি কখনোই ৩৪ শতাংশের নিচে বিদ্যুৎ নিতে পারবে না। বাংলাদেশ যদি কম বিদ্যুৎ নেয়, তাহলেও ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যত কয়লা ব্যবহার করা হতো, তার পুরোটার দাম বাংলাদেশ আদানিকে দেবে। শুধু কয়লার দামই নয়, কয়লা পরিবহনের জাহাজভাড়া, বন্দরের ব্যয় ও কয়লার পরিবহনের অর্থও পাবে আদানি।
পটুয়াখালীর পায়রায় স্থাপিত সরকারি প্রতিষ্ঠান আরপিসিএল ও নরেনকোর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৯৩ দশমিক ৪৮ গ্রাম কয়লার দাম পাবে। অথচ একই পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য আদানি পাবে ৫৫৫ দশমিক ৪৩ গ্রাম কয়লা। এতে বাড়তি কয়লার দাম বাবদ বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি নিয়ে যাবে আদানি।

অসম চুক্তির কারণে ক্যাপাসিটি পেমেন্টও বেশি দেয়া হয়েছে আদানিকে। ক্যাপাসিটি পেমেন্টের মধ্যে চারটি অংশ রয়েছে। এগুলো হলো পরিবর্তনশীল কেন্দ্র ভাড়া, স্থির কেন্দ্র ভাড়া, ইউএস সিপি ইনডেক্স (যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার) ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ। আদানির বিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি শুধু ক্যাপাসিটি পেমেন্টই পড়বে প্রায় ৬ সেন্ট, যা দেশীয় মুদ্রায় ৭ টাকা ২০ পয়সা। সে হিসাবে বছরে আদানি শুধু কেন্দ্র ভাড়াই নেবে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের গ্যাসভিত্তিক ও তেলভিত্তিক বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় ইউনিটপ্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ ৯০ পয়সা থেকে ১ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত।

আদানির সাথে চুক্তিতে কয়লার সিস্টেম লস ধরা হয়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ১ লাখ টন কয়লা পরিবহনের সময় ১ হাজার ১০০ টন নষ্ট হয়ে গেছে দাবি করে তার দাম নিতে পারবে আদানি। পায়রায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ও রামপাল কেন্দ্রে সিস্টেম লসের বিধান রাখা হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম বাংলাদেশ সফরের ২ মাসের মাথায় ১১ আগস্ট আদানি পাওয়ারের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে পিডিবি। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের ভেতরেই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করার প্রস্তাব ছিল আদানির। কিন্তু সমঝোতার ২ বছর পর ২০১৭ সালে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি কেন করেছিল, এর কোনো যৌক্তিকতাই খুঁজে পাওয়া যায় না।

 


আরো সংবাদ



premium cement