১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

আ’লীগের মতো আচরণ করলে বিএনপিরও একই দশা হবে : মির্জা ফখরুল

ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর : নয়া দিগন্ত -


বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজকে আমরা মুক্ত বাংলাদেশে বাস করছি; কিন্তু মনে রাখবেন সে দিন পর্যন্ত এটি মুক্ত থাকবে যে দিন পর্যন্ত আমরা এটিকে স্বাধীনভাবে রাখতে পারব। আমরা যদি আবার আওয়ামী লীগের মতো শুরু করি তাহলে কি আমরা টিকতে পারব? উপস্থিত নেতাকর্মীরা না সূচক জবাব দিলে ফখরুল বলেন, তাদের মতো (আওয়ামী লীগের) একই আচরণ করলে একই রকম দশা হবে আমাদেরও। সেই জন্য আমরা যারা লড়াই করেছি সংগ্রাম করেছি তাদের প্রতি আমার আকণ্ঠ অনুরোধ আপনারা নিজেদেরকে মানুষের কাছে প্রিয় বানান, ভালোবাসার পাত্র হিসেবে তৈরি করেন। কারো ওপর অন্যায় অত্যাচার নির্যাতন করবেন না। বুধবার দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা ঈদগাহ মাঠে বিএনপি আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভয়াবহ দানব ফ্যাসিবাদ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। তার পতনের আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার খুন করেছে প্রায় দুই হাজার মানুষকে। কারো হাত চলে গেছে, কারো পা চলে গেছে, কারো মাথার খুলি উড়ে গেছে। এরা কেউ কলেজে পড়ত কেউবা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। কেউ শ্রমিক, কেউ দিনমজুর, কেউ শিশু। এসব মানুষকে হাসিনা খুন করেছে। গত ১৫-১৬ বছরে আমরা খুব কষ্ট পেয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনা আমাদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন ও জেল জুলুম করেছে। আপনাদের এখানে মামলা হয়েছে শুধু বিএনপি করার অপরাধে, জামায়াত করার অপরাধে, আপনাদেরকে জেলে রাখা হয়েছে। সেই অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। যে শেখ হাসিনা সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হয়ে গিয়েছিল, তাকে ঠিক সেভাবে পালিয়ে যেতে হয়েছে। জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে। চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে লাখ লাখ মানুষ গণভবন দখলে আসছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে হেলিকপ্টারে করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে তিনি জীবন রক্ষা করেন। আর যারা এখানে দাপটের সাথে আমাদেরকে শাসন করত, আমাদেরকে জেলে দিত, জুলুম করত, জমি দখল করে নিত, ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে নিত, আমাদেরকে রাজনীতি করতে দিত না, আজ তারা জেলের ভেতরে ঢুকেছে।

পবিত্র কুরআনের সূরা ইমরানের একটি আয়াত আরবিতে তিলওয়াত করে তা বাংলায় অনুবাদ করে ফখরুল বলেন, সীমা লঙ্ঘন করো না, সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না। আল্লাহ বলেন, আমি যাকে ইচ্ছা মালিক বানাই, বাদশাহ বানাই, রাষ্ট্রপতি বানাই, প্রধানমন্ত্রী বানাই আবার তাকে যেকোনো সময় রাস্তার ফকির বানিয়ে দিই। আজকে সেই প্রতাপশালী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে সেই করুণ অবস্থার মধ্যে পড়েছে। যারা কিনা দাপটের সাথে আনাদের শাসন করত, জুলুম-নির্যাতন করত, জমি নিয়ে নিত, ব্যবসা নিয়ে নিত, কাউকে কিছু করতে দিত না। আজকে তারা জেলের ভেতরে চলে গেছে।
ফখরুল বলেন, আমি ১১ বার কারাগারে গিয়েছি। আমরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বছরের পর বছর লড়াই সংগ্রাম করেছি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের জন্য অনেক করেছেন, তিনি অসুস্থ। আমরা তার সুস্থতার জন্য দোয়া করি, আল্লøাহ তাকে আবার সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

ফখরুল বলেন, মরহুম জামায়াত নেতা গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে আট বছর আয়নাঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। আমাদের অনেক নেতাকর্মীকে এই আয়নাঘরে রাখা হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীর খবরই পাই না। ১২ বছর আগে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ এখন পর্যন্ত তার কোনো খবরই পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী-সন্তানরা জানে না তার মৃত্যুদিবস পালন করবে শহীদ হিসেবে, না আল্লাহ তাকে ভালোভাবে ফিরিয়ে দিক সে দোয়া করবে। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সমস্ত নামীদামি মানুষকে টর্চার করার জন্য আয়নাঘর বানিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে সেখানে নির্যাতন করা হতো। আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ে অসংখ্য ছেলেকে গুলি করেছে অসংখ্য মামলা হয়েছে। বারবার জেলে গিয়েছে আমাদের ছেলেরা; কিন্তু কখনো সত্যের পথ থেকে সরে দাঁড়ায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নতুন যে অন্তর্বর্তী সরকার আছে, তারাও বলেছে যে, কিছু কিছু কাজ আওয়ামী লীগ খুব খারাপ করে গেছে, যেমন মানুষের ভোটের আধিকার ছিল না, কেউ ভোট দিতে পারেনি। সর্বত্র দুর্নীতি, দলীয়করণ, মামলা, হামলা, জেল-জুলুম, সেই জিনিসগুলো ঠিক করতে সময় দিতে হবে। রাতারাতি সবকিছু ঠিক করা সম্ভব নয়। তাই সরকারকে আমরা সেই সময়টুকু দিতে চাই। তারা নিরপেক্ষ, আমাদের উচিত তাদের সহযোগিতা করা।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা আমাদের আমানত। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমানত যে খেয়ানত করে সে মুমিন না। এ আমানতকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। সামনে পূজা আসছে পূজাকে কেন্দ্র করে কোথাও যেন অঘটন না ঘটে সে দিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
নিজের অসুস্থতার কারণে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে না পারায় নেতাকর্মীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সভা শেষ করেন ফখরুল।
হরিপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি জামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন- কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য জেড মর্তুজা তুলা, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফয়সল আমিনসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। বিকেলে জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা ও রুহিয়া থানা বিএনপির আয়োজিত পৃথক সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তিনি।

প্রশাসন এখনো ফ্যাসিবাদ মুক্ত হতে পারেনি
বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) সংবাদদাতা জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা বিএনপির আয়োজিত স্থানীয় সমির উদ্দীন স্মৃতি মহাবিদ্যালয় মাঠে বুধবার বেলা ৩টায় বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, প্রশাসন এখন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ মুক্ত হতে পারেনি। এই ফ্যাসিবাদ মুক্ত হতে না পারার প্রধান কারণ হচ্ছে, এত ডিপ রুটে চলে গিয়েছিল ফ্যাসিবাদ, সেখান থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লোকজনকে খুঁজে বের করা কঠিন হচ্ছে। এখানে আমাদের যেটা প্রয়োজন ছিল ঐক্য অটুট রাখা। এই সরকারের সমস্ত কাজকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা। নিজেদের মধ্যকার সম্মিলিত ঐক্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আমরা ফ্যাসিবাদকে সরিয়েছি, হাসিনাকে সরিয়েছি। এখন একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদেরকে অতিদ্রুত সংস্কারের মধ্য দিয়ে তারা নির্বাচনে যাবে। যে নির্বাচনটা অবাধ নিরপেক্ষ হবে।

বিএনপি সাথে আওয়ামী লীগের তুলনা নয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত অপপ্রচার। এটা করেই কিন্তু যারা দুষ্টু, যারা সবসময় ফয়দা লুটতে চায়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তুলনা হতেই পারে না। কারণ আওয়ামী লীগ কোনো গণতান্ত্রিক দল নয়, গণবিরোধী একটা দল। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গণতান্ত্রিক মানুষকে হত্যাকারী একটি দল। আর বিএনপি হচ্ছে গণতন্ত্রকে জীবন্ত করার দল। ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান একদলীয় রাজনীতি থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে এসেছেন। আমরাই কেয়ারটেকার সিস্টেম চালু করেছি। সুতরাং এ দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ফান্ডামেন্টাল জিনিস প্রত্যেকটা আমাদের হাতে গড়া এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর আমরা করেছি।

তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতাকে যখনই গ্রাস করেছে স্বৈরতন্ত্র, প্রতিবারই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে বিএনপি। ১৬ বছরের স্বৈরাচারী দুঃশাসনকে চূর্ণ করে, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ মুক্তির স্বাদ পায়, গণতন্ত্রের পথ সুগম হয়। অসংখ্য ব্যক্তি ও পরিবার রয়েছে, যাদের বছরের পর বছর ধরে ত্যাগের মহিমায় আমরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের ঐক্যকে ধারণ করে, গণতন্ত্রের পক্ষের সব শক্তির বলিষ্ঠ ভূমিকায় ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। বাংলাদেশের জনগণের এই বিজয় শুধুই দেশের মালিকানা ফিরে পাওয়ার বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রতিশ্রুতি, যা অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত।
দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে চলমান অস্থিরতা ফ্যাসিবাদের দোসরদের ইঙ্গিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টগুলোতে যে অশান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, এতে সুস্পষ্টভাবে ফ্যাসিবাদের দোসরদেরই ইঙ্গিত আছে। এই জিনিসগুলো থেকে মনে হচ্ছে যে, একটা চক্রান্ত চলছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সোস্যাল মিডিয়ায় বা সাংবাদিকদের কাছে থেকে শুনে যা বুঝি যে, সীমান্তের ওপার থেকে কথিত ফ্যাসিবাদী হাসিনার অডিও-টডিও ফাঁস করে দেয়া হয়, যেগুলোতে বিভ্রান্তিকর খবর থাকে। অন্য দিকে আবার প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে যারা ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু তাদের ওপরে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। যেটা টোটালি বাঁকাওয়াজ। এটা আমরা শুধু নয়, ভারত থেকে যেসব সাংবাদিকরা এসেছিলেন তারা পর্যন্ত দেখে গেছেন। তারা রিপোর্ট করেছেন, তারা বলেছেন, যেটা বলা হচ্ছে সেটা সঠিক নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ আলমের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ড. টি এম মাহাবুবর রহমানের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- ডক্টরস্ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব ডাক্তার আব্দুস সালাম, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য ও ঠাকুরগাঁও- আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জেড মূর্তুজা চৌধুরী তুলা, ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফয়সাল আমিন, সহ-সভাপতি কাজী ফাহিম উদ্দীন, ওবাদুল্লাহ মাসুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু হায়াত নুরুন্নবী, জেলা মহিলা দলের সভানেত্রী সূরাতুন নেচ্ছা, ঠাকুরগাঁও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাভোকেট জয়নাল আবেদীন, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি অ্যাভোকেট ইউসুফ আলী, ফয়জুল ইসলাম হিরু, সাংগঠনিক সম্পাদক খোরশেদ আলম, অ্যাভোকেট আবেদুর রহমান, এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয়, জেলা ও ঠাকুরগাঁও জেলার পাঁচটি উপজেলার বিএনপির নেতৃবৃন্দ।

 


আরো সংবাদ



premium cement