২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
গণতন্ত্র সমাবেশে তারেক রহমান

অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না

সরকারের ভেতরে আওয়ামী প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে : মির্জা ফখরুল
নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে বিপুল উপস্থিতি। ইনসেটে বক্তব্য রাখছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর : নয়া দিগন্ত -


রাষ্ট্র সংস্কারের পথ ধরে দেশ নির্বাচনী রোডম্যাপে উঠবে এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। তবে সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে তাদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে। একই সাথে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা বিষয়ে তিনি বলেন, এতে দোষের কিছু নেই। কারণ, জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন দেবে।
গতকাল মঙ্গলবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত বিশাল সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বিএনপি এই সমাবেশের আয়োজন করে।
তারেক রহমান বলেন, পতিত স্বৈরাচারের পলায়নের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক-মানবিক বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রধান বাধা দূর হয়েছে। তবে বাধা দূর হলেও মাফিয়া চক্রের রেখে যাওয়া ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর হয়নি। এই জঞ্জাল দূর করে দেশে জনগণের ভোটে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। তবে মাফিয়া চক্রের প্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেও মাফিয়া চক্রের সুবিধাভোগী অপশক্তি প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে কিংবা রাজনীতির ছদ্মাবরণে সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে সরকারকে সতর্ক করেন তিনি। বর্তমান সরকার গণ অভ্যুত্থানের সরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সরকারের কোনো কোনো কার্যক্রম সবার কাছে হয়তো সাফল্য হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। কিন্তু এই সরকারের ব্যর্থতা হবে আমাদের সবার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের পক্ষের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা। এটি আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখতে হবে।’

সম্প্রতি একটি নতুন দল গঠনের বিষয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এই বিষয়ে সমাবেশে তারেক রহমান তার দলের অবস্থান জানাতে গিয়ে বলেন, ‘কেউ যদি মনে করেন, একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরো নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে,তাতে দোষের কিছু নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত, জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না। এ কারণেই, বিএনপি বারবার জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে। বিএনপি মনে করে, একমাত্র অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই, রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সাথে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশীদারিত্ব তৈরি হয়।’

সমাবেশে অংশ নিতে দুপুরের আগেই নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে আসেন। দুপুর গড়াতেই কার্যালয় ও এর আশপাশ এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলে তারেক রহমান যখন ভার্চুয়ালি সমাবেশে যুক্ত হন তখন নেতাকর্মীরা করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানায়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ কিংবা যেকোনো দেশেই গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই জনগণ সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে, রাখবে। তবে কোনো এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহিতাও কিন্তু নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা হয়। সুতরাং, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই এই সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংস্কারকার্যক্রম এগিয়ে নেয়া দরকার বলে মনে করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কারকার্যক্রমের প্রক্রিয়ায় জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়া উন্নয়ন-গণতন্ত্র কিংবা সংস্কার কোনোটিই টেকসই এবং কার্যকর হয় না। একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি ভোটারের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করে ভোটারদের কাক্সিক্ষত প্রতিনিধি নির্বাচন করারঅধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন জনপ্রশাসনের সংস্কার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘সক্ষম এবং উপযুক্ত’ করে গড়ে তুলতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এজেন্ডা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে না পারলে গণ অভ্যুত্থানের সাফল্য ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্রকারী চক্র নানা সুযোগ গ্রহণ করতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করেন তিনি। তারেক রহমান বলেন, সরকার ইতোমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারকার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর কিছু আলামত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে সরকার পতনের ঘটনা উল্লেখ করে বিএনপির শীর্ষ নেতা বলেন, বাংলাদেশের জনগণ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে রাজি তবুও স্বৈরশাসন মেনে নেয় না।
তারেক রহমানের ভাষায়, ‘লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্র-রাজনীতি শাসন প্রশাসন হওয়ার কথা ছিল গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল। অথচ গত ১৫ বছর বাংলাদেশে মাফিয়া শাসন চালু করা হয়েছিল। দেশে বিদেশে পলাতক স্বৈরাচার বিনাভোটের সরকারের পরিচয় হয়ে উঠেছিল গভর্নমেন্ট অব দ্য মাফিয়া বাই দ্য মাফিয়া ফর দ্য মাফিয়া।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অভিযোগ, আওয়ামী মাফিয়া চক্র দেশকে সর্বক্ষেত্রে ভঙ্গুর করে দিয়েছিল। দেশকে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ঋণনির্ভর এবং পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। মাফিয়া চক্র দেশের ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করে দিয়েছে। গত দেড় দশকে দেশ থেকে ১৭ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করে দিয়েছে। ৫ আগস্টের পতিত স্বৈরাচারের বেপরোয়া দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বর্তমানে ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে আজ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই সেই শিশুটিরও মাথাপিছু ঋণ কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা।
তারেক রহমান বলেন, মাফিয়া চক্র দেশকে শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই ভঙ্গুর করে দেয়নি, দেশের আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক রীতিনীতিকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রতি সাংবিধানিক এবং বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান অকার্যকর করে ফেলা হয়েছিল। খোদ ফ্যাসিবাদকেই বিচার বিভাগের সূতিকাগারে পরিণত করা হয়েছে। একটি রাষ্ট্র কতটা সভ্য এবং গণতান্ত্রিক সেটি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু মাফিয়া চক্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। অন্যায় অনিয়ম আর অরাজকতার বিরুদ্ধে গণ বিস্ফোরণে মাফিয়া চক্রের প্রধান দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশে মাফিয়া শাসন-শোষণের অবসান ঘটেছে।

বিএনপির দেয়া ৩১ দফার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২২ সালে বাংলাদেশের পক্ষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। তবে ঘোষিত ৩১ দফাই শেষ কথা নয়। বিএনপি মনে করে, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই সংস্কারকার্যক্রম একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং, রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সংস্কারে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচির আরো প্রয়োজনীয় পরিবর্তন পরিমার্জনকেও বিএনপি স্বাগত জানায়।
সংস্কারকার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, গণ অভ্যুত্থান কিংবা সংস্কারকার্যক্রম নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানারকম কথা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটি একটি স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য রীতি। প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবেন, এটিই স্বাভাবিক। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, ফৌজদারি অপরাধের বিচার যেমন বিচারিক আদালতে হয় ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজনৈতিক আচরণের বিচার হয় জনগণের আদালতে।
তারেক রহমান বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধুই রাষ্ট্র ক্ষমতার হাত বদল নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাষ্ট্র এবং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মনে রাখা প্রয়োজন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের আচার-আচরণেও গুণগত পরিবর্তন জরুরি। সুতরাং, আমার আহ্বান কোনো প্রলোভন কিংবা উসকানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র এবং সমাজের নেতৃত্ব দানের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখুন।’
নেতাকর্মীদের আরো ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার এই যাত্রাপথে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে হয়তো আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আরো কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সেই পথ সন্ত্রাস-সংঘর্ষ-প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসার নয়। সেই পথ হবে ধৈর্য-সহনশীলতা এবং সমঝোতার। সুতরাং আসুন, আমরা সবাই কাজের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস ভালোবাসা অর্জন করি। জনগণের সাথে থাকি। জনগণকে সাথে রাখি।’
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তা হেলায় হারানো যাবে না। এখনো যারা গণতন্ত্র নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে তাদের রুখে দিতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকারের ভেতর এখনো আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে। প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্র থেকে এদের সরাতে হবে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, ছাত্র-জনতার জনস্রোতে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভেসে গেছেন। এক্ষেত্রে তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে।
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্ব এবং দলের প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগরীর নেতা আমিনুল হক ও তানভীর আহমেদ রবীনের পরিচালনায় বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, আসাদুজ্জামান রিপন, রুহুল কবির রিজভী, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আবদুল সালাম আজাদ, ফজলুল হক মিলন, রফিকুল আলম মজনু, আফরোজা আব্বাস, আবদুল মোনায়েম মুন্না, রাজিব আহসন, নিপুণ রায় চৌধুরী, রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন জারি রাখার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন আমরা করেছিলাম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। সেই কেয়ারটেকার সরকার বিলুপ্ত করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নতুনভাবে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদি শাসনের প্রবর্তন করে। অন্তঃহীন সংগ্রাম, ত্যাগ তিতিক্ষা, রক্ত শ্রম এবং প্রাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ পুনরায় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই স্বাধীনতা, এই গণতন্ত্রের জন্য যারা যুদ্ধ করেছে, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম শহীদ রংপুরের সাঈদ, দ্বিতীয় শহিদ চকরিয়া পেকুয়ার সন্তান ওয়াসিম।

বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নগরীর আলমাস মোড়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপি আয়োজিত কেন্দ্রঘোষিত গণতন্ত্রের শোভাযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সালাউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রাটি আলমাস হয়ে কাজীর দেউরি, লাভ লেইন, জুবলী রোড়, নিউ মার্কেট, কোতোয়ালি হয়ে লালদীঘি পাড়ে এসে শেষ হয়।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব নাজিমুর রহমানের পরিচালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়নাল আবেদীন ফারুক, গোলাম আকবর খোন্দকার, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ডা: শাহাদাত হোসেন। এতে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় বিএনপির শ্রম সম্পাদক এ এম নাজিম উদ্দীন, সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ভিপি হারুনুর রশীদ, ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী, খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রমুখ।

ময়মনসিংহ অফিস জানায়, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেছেন, বর্তমান সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল। এই আন্দোলনে বিএনপিও অংশগ্রহণ করেছে। দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পটভূমিতেই এই আন্দোলনে চূড়ান্ত ফল লাভ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপির সমর্থন আছে। বর্তমান সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক দায়িত্ব নেবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ময়মনসিংহ নগরীর সার্কিট হাউজ মাঠে বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বিভাগীয় শোভাযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, গণতন্ত্রের আন্দোলনে অনেক নেতাকে গুম, খুন ও ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে, জেল-জুলুম দেয়া হয়েছে। এখন এই দেশ নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে। ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক এ কে এম শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে শোভাযাত্র-পূর্ব সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সাংগঠনিক সম্পাদক শরীফুল আলম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়ারেস আলী মামুন ও আবু ওয়াহাব আকন্দ প্রমুখ। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আফজাল এইচ খান, সাবেক এমপি শাহ নুরুল কবীর শাহীনসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে লাখো জনতার শোভাযাত্রা নগরীর টাউন হল মোড় থেকে শুরু হয়ে গাঙ্গিনারপাড় হয়ে রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে গিয়ে শেষ হয়।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো: শাহজাহান বলেছেন, যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে বিতারিত করা হয়েছে তেমনিভাবে এ দলের (আওয়ামী লীগের) কবর রচনা না করা পর্যন্ত আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, বিএনপি এককভাবে সরকার গঠন করেছে, এখনো সরকার গঠনের শক্তি রাখে তারপরও বিএনপির নেতা তারেক রহমান জাতীয় ঐক্যর স্বার্থে, এ দেশটাকে গড়ার স্বার্থে ও যে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষায় মানুষ রক্ত দিয়েছে সে পরিবর্তনকে অর্থবহ করার জন্য, রাষ্ট্র সংস্কার গঠনের স্বার্থে এককভাবে নয় জাতীয় সরকার গঠন করে দেশটাকে পরিষ্কার করতে চাই।

আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে টাউন হল মাঠে কুমিল্লায় বিভাগীয় সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বত্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, মোস্তাক আহম্মেদ, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব জসিম উদ্দিন, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক উৎবাতুল বারী আবু, সদস্যসচিব ইউসূফ মোল্লা টিপুসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশ শেষে একটি শোভাযাত্রা বের হয়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। সমাবেশে কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেছেন, জনগণের অধিকার নিশ্চিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি বিগত ১৭ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আজকে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে গুম, খুন, নিপীড়নের হাত থেকে জনগণ মুক্তি পেয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বরিশাল মহানগরীর বান্দ রোড প্লানেট ওয়ার্ল্ড শিশু পার্কের সামনে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সেলিমা রহমান বলেন, আমরা জনগণের জন্য কাজ করছি। আমরা চেষ্টা করছি সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে। সব মানুষের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, জনগণের স্বাধীনতা, ভোটের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব দুই বছর আগে দিয়েছি। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে রাষ্ট্র সংস্কার করে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করব।
বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুকের সভাপতিত্বে বেলা ১১টায় শুরু হওয়া সমাবেশ চলে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। এর আগে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বরিশাল ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমাবেশস্থলে জমায়েত হন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা। স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।

সিলেট প্রতিনিধি জানান, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেছেন, ৩৬ দিনের আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন বিএনপির দীর্ঘ ১৫ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত ফলাফল। ছাত্রদের ডাকে বিএনপিসহ ৬৩টি রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। যার ফলে খুনি হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই আন্দোলনে নিহতের সাড়ে আট শতাধিক শহীদের মধ্যে ৪২২ জন ছিল বিএনপির নেতাকর্মী।
তিনি বলেন, বিএনপি গত ১৫টি বছর ধরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন করে আসছে। বিএনপির আন্দোলন দমিয়ে রাখতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার জননেতা এম ইলিয়াস আলীসহ দলের ৫২২ জন নেতাকর্মীকে গুম করেছে। বিএনপির ১০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে এরাও এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন হিসেবে গুনতে হবে। জালিম হাসিনার রোষানলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন ১০ লাখ নেতাকর্মী। এরপরও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপি রাজপথ ছাড়েনি।
তিনি মঙ্গলবার বিকেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে সিলেট বিভাগ বিএনপি আয়োজিত বিভাগীয় র‌্যালিপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান অতিথি সিলেটের মরহুম গুণীজনকে স্মরণ করে বলেন, শহীদ জিয়া সিলেট সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তারেক রহমান সিলেটের জামাই। তাই জিয়া পরিবারের সাথে সিলেটের সম্পর্ক অনেক গভীর। সিলেট বিএনপির ঘাঁটি। এখানে শাহজালাল ও শাহপরানসহ অনেক ওলী-আউলিয়া শুয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন সিলেটের সন্তান। এ ছাড়া মরহুম রিয়াল অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান, এম সাইফুর রহমান, হারিছ চৌধুরীও সিলেটের সন্তান। আমরা তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ও রূহের মাগফিরাত কামনা করি। নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীসহ গুম হওয়া সব নেতাকর্মীর সন্ধান চাই।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মিফতাহ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীর যৌথ পরিচালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদী লুনা, সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গৌছ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন, সাবেক এমপি শাম্মী আক্তার, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা: শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী, আবুল কাহের চৌধুরী শামীম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সিলেট জেলা সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয়, সিলেট বিভাগ ও ৪ জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।

রংপুর ব্যুরো জানায়, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজব (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম বলেছেন, ‘আজকে কারো কারো মনে হতে পারে, বোধহয় ছাত্ররাই শুধু জুলাই-আগস্টের এই বিপ্লব করেছে। এই বিপ্লবের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করেছে বিএনপির সারা দেশের সাহসী সৈনিকরা। গত ১৭ বছর আমরা লড়াই করেছি। কল্পনা করে দেখুন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আমরা যে সভা করেছি। নদী সাঁতরিয়ে মানুষ এসেছে। হাজারো বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে উত্তাল তরঙ্গের মতো, সাগরের ঢেউয়ের মতো গর্জন করে বাংলাদেশে বিএনপির বীর সৈনিকরা সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে গণতন্ত্র মুক্তির জন্য কাজ করেছেন ।
আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গতকাল বিকেলে রংপুর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে বিভাগীয় গণতন্ত্র শোভাযাত্রার উদ্বোধন সমাবেশে এই মন্তব্য করেন তিনি। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামুর সভাপতিতে সমাবেশে রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম, মহানগর সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজুর নবী ডন, জেলা সদস্যসচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement