১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সীমান্তে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ : যুদ্ধের আশঙ্কা

-

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মির সশস্ত্র ক্যাডাররা। এখন বুথিডাং-এর মতো শহরসহ বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে আছে তারা। বঙ্গোপসাগরের উপকূলরেখার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো যেমন কিয়াউক ফিউ, সিটওয়েকে হুমকি দিতে দেখা যায় তাদের। আরাকান আর্মির এ ধরনের তৎপরতা ভূকৌশলগতভাবে এই এলাকায় বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ ধরনের বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভবত একটি গেম চেঞ্জার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হাসিনার অ-হস্তক্ষেপ নীতি পরিত্যাগ করে ঢাকার নতুন শাসন ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়া সময়ের ব্যাপার। পশ্চিমা স্বার্থের অত্যন্ত কৌশলগত ককপিট হিসেবে বঙ্গোপসাগরের উপকূলরেখা বরাবর রাখাইনে প্রোটো-রাষ্ট্র তৈরি করা একটি স্বতন্ত্র সম্ভাবনা।
বাংলাদেশ এরই মধ্যে রাখাইনের তিনটি এলাকাকে নিরাপদ করার জন্য রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির সমর্থনে একটি প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে জনসংখ্যার ৩৫% রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের বাসস্থান সেখানে সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত লোকদের অন্যত্র স্থানান্তর করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে (প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ) এবং তা হতে পারে জাতিসঙ্ঘের মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে। মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এই ধারণার বিরোধী। রাখাইনের উত্তরে, আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে একটি জটিল ত্রিমুখী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে যাতে রোহিঙ্গা মুসলিমরাও জড়িত। আরাকান আর্মির লক্ষ্য বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত ছিটমহল তৈরি করা যা রাখাইনের জনসংখ্যার ৬৫% নিয়ে গঠিত।
আরাকান আর্মি বর্তমানে কেন্দ্র ও উত্তরে ৯টি টাউনশিপ এবং সেই সাথে বাংলাদেশ সীমান্তের অনেক অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি শিগগরিই আরাকান রাজ্যের রাজধানী সিটওয়ে এবং সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ড সদর দফতরকে আরো দক্ষিণে নিয়ে যেতে পারে। রাখাইন জনগণের মধ্যে আরাকান আর্মি অত্যন্ত জনপ্রিয়। মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ রাখাইনে একটি নৃশংস যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে যেখানে বহিরাগত শক্তি জড়িত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত।
এক বিবৃতিতে, ব্রাসেলস-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ মে মাসে অনুমান করে বলেছে যে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে, ‘সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হাজার হাজার যোদ্ধা সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করেছে... (এবং) নিয়োগ অভিযান নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে... বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এটি বন্ধ করতে খুব কমই কাজ করেছে।’ এটা অবশ্য শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার সময়।
আরাকান কৌশলগত দিক থেকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তেল এবং গ্যাস পাইপলাইনগুলো কিয়াউক ফিউ থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত গেছে। কিয়াউক ফিউ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর সম্প্রসারণ ও আরো কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। সিটওয়েতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ভারতের কালাদান প্রকল্পের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা মিয়ানমার হয়ে মিজোরামের সাথে কলকাতাকে সংযুক্ত করতে চায়।
আরাকান আর্মি বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের গতিপথকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাসহ বঙ্গোপসাগরের আঞ্চলিক নিরাপত্তা গতিশীল করার অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো যেমন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমর্থিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সগুলো এখন পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত রয়েছে। তবে এটি বর্তমানের জন্য একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। কাকতালীয় হোক বা না হোক, মিয়ানমারের পাশের দরজায়, মনিপুরে দিল্লি যখন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সংলাপের পথে হাঁটছে না তখন কী ঘটে তার একটি পূর্বরূপ আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য দেশটির সরকারের দ্বিধাকে তুলে ধরেছে : ‘জাতিগত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কিছু ইতিবাচক অঙ্গভঙ্গি দরকার, কিন্তু [মুখ্যমন্ত্রী] সিং স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনের কুকি দাবির সম্পূর্ণ বিরোধী। তাকে বুঝতে হবে যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরামর্শ যে, শান্তি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসে না, আলোচনার মাধ্যমে আসে, মণিপুরের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। গত বৃহস্পতিবার, আরাকান আর্মি ঘোষণা করেছে যে তারা নৌবাহিনীর জাহাজ এবং বিমান দ্বারা সমর্থিত সরকারি বাহিনীর প্রতিরোধকে কাটিয়ে এক মাসের তীব্র লড়াইয়ের পর দক্ষিণ রাখাইন রাজ্যে নেভি সিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দখল করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মতো, মিয়ানমারের জাতিগত ভূগোলগুলি জটিল। কয়েক দশক ধরে অভ্যন্তরীণভাবে মানুষের যথেষ্ট চলাচলের পরিপ্রেক্ষিতে, কোনো ‘খাঁটি’ জাতিগত আবাসভূমি নেই। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা প্রায়শই শহর ও শহুরে স্থান ভাগ করে নেয়। আরাকান আর্মি হলো একটি বৌদ্ধ জাতিগত গোষ্ঠী এবং ভারতেও রাখাইন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৮৪ সালে বার্মা সরকার নিজেদের দখলে নেয়। কিন্তু প্রথম অ্যাংলো-বর্মী যুদ্ধের মাত্র ৪২ বছর পর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্রিটিশ ভারতকে হস্তান্তর করা হয়েছিল। যাই হোক, ১৯৩৭ সালে আরাকানকে ব্রিটিশ ভারত থেকে বিভক্ত করে ব্রিটিশ বার্মার একটি ক্রাউন কলোনি করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ আরাকানি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিবাদ বর্তমান বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক অভিবাসনের পর ঔপনিবেশিক যুগে ফিরে আসে।
সিনোফোবিক ভারতীয় ভাষ্যকাররা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ভারত ও চীনের মধ্যে নিরাপত্তা স্বার্থের সংঘাতের কথা তুলে ধরছেন। (কিছু বিশ্লেষক বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনে চীনের হাত আছে ধারণা করছেন।) ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে চীনের দিকে ইঙ্গিত করার কোনো অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণ নেই।
এভাবে, চীন অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে, বিশেষ করে ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডাব্লিউএসএ) এবং থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের (যারা আরকান আর্মি একটি উপাদান।) সাথে পূর্ণ সম্পর্ক রাখে। মজার বিষয় হলো, চীন ইউডাব্লিউএসএকে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে কল্পনা করে এবং এটিকে চীনা বাজার থেকে বাণিজ্যিক ড্রোন সংগ্রহ করতে ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অপারেশনে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। ধারণা করা যায়, ইউডাব্লিউএসএ একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে যার মাধ্যমে চীনা অস্ত্র অন্যান্য বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাবে।
চলতি মাসে প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সবই চীনকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাধা দেয় না। গত দুই বছরে চীন মিয়ানমারকে ‘জঙ্গি বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, নৌ সরঞ্জাম এবং অন্যান্য দ্বৈত ব্যবহারের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। তর্কাতীতভাবে, মিয়ানমারের স্থিতিশীলতার জন্য নেপিডোতে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য চীন, ভারত এবং আসিয়ানের মধ্যে স্বার্থের সমঝোতা রয়েছে। তবে শুধু চীনই সক্রিয়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর ১৪ আগস্ট নেপিতাও সফর মিয়ানমারের সঙ্কট সমাধানে একটি নতুন ধাক্কা। এর দুই দিন পরে, চিয়াংমাইতে মেকং-ল্যাঙ্কাং সহযোগিতা পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের সাইডলাইনে, ওয়াং লাওস, মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের প্রতিপক্ষের সাথে চীনের সামনে একটি ৩-দফা পন্থা পেশ করেন যে, ‘মিয়ানমারের নাগরিক বিবাদে পড়ে আসিয়ান পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয় এবং বহিরাগত শক্তির অনুপ্রবেশ এবং হস্তক্ষেপের অনুমতি দেয়া উচিত নয়।’
চার দিন পর, ওয়াং বেইজিংয়ে মিয়ানমারের জন্য জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত জুলি বিশপের সাথে দেখা করেন, যেখানে তিনি ‘মিয়ানমারের মালিকানাধীন, মিয়ানমারের নেতৃত্বে’ শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি চীনের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করেন। একই দিনে, পিপলস লিবারেশন আর্মির দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ড মিয়ানমারের সাথে চীনের সীমান্তে লাইভ-ফায়ার ড্রিলের সফল সমাপ্তি ঘোষণা দেয়।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল