১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
শহীদদের স্বজনদের আর্তনাদ, বিচার দাবি

আওয়ামী হায়েনাদের আক্রমণ প্রতিহত করুন : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ। ইনসেটে নেতৃবৃন্দ: নয়া দিগন্ত -

গোপালগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানীর উপর হামলা ও সংগঠনটির ক্রীড়া সম্পাদক শওকত আলী দিদারকে শহীদ করা হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এখনো আওয়ামী লীগের হায়েনারা লুকিয়ে আছে, সুযোগ পেলে যেকোনো সময় আবার তারা আক্রমণ করবে। এই হায়েনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।
গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণে বিএনপি আয়োজিত সভায় মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ সবসময় আত্মত্যাগ ও প্রাণ দিয়েছে। ’৭১ সালে যখন আমরা স্বাধীন হলাম, তখন ভেবেছিলাম সত্যিকার অর্থে আমরা একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ পাব। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার ছিলেন প্রথম তাদের অর্থাৎ আওয়ামী লীগের হাতেই গণতন্ত্র ধ্বংস হয়। ১৯৭৫ সালে তারা একদলীয় বাকশাল কায়েম করে। এ কথা একবার বললে হবে না, বারবার বলতে হবে। এই দলটি আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। ছাত্রদের আন্দোলনকে বারবার দমন করতে নির্যাতন, গুম, খুন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের হাতে গত জুলাই-আগস্ট মাসসহ গত ১৬ বছরে এ দেশের অসংখ্য গণতান্ত্রিক মানুষ জীবন দিয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব আন্দোলনে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন তাদের অভিবাদন জানান। এ সময় তিনি বলেন, স্যালুট বেগম খালেদা জিয়াকে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে যিনি কখনো আপস করেননি, মাথা নোয়াননি। দীর্ঘ ছয় বছর কারাগারে ছিলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি মুক্ত হয়েছেন। সেই সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও অভিবাদন। মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে আমরা হয়তোবা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু চারদিকে নাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস। তারা তাদের চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে। আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির জন্য পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। নেতাকর্মীদের কোনোভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে পা না দেয়ার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থান ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পেয়েছি। এই সরকারের কাছে দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা আকাশচুম্বী। জনগণের আশা, তারা একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির মাধ্যমে নির্বাচন দেবে, যাতে করে সত্যিকার অর্থে আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৬ বছর ধরে যারা পঙ্গু ও নিহত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে সরকার প্রধানের কাছে দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব। একই সাথে এই সময়ে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তা অতি দ্রুত প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান।
মির্জা ফখরুল বলেন, জাতির কাছে অঙ্গীকার করতে চাই, সত্যিকার অর্থে প্রকৃত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাব। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে চক্রান্তের মধ্য দিয়ে কেউ যেন আমাদের বিপথে না নিয়ে যায়। কোনোমতেই আমরা যেন আমাদের লক্ষ্য ও পথ না হারাই।
স্মরণ সভায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)’র চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আওয়ামী লীগ দাঁড়ানোর জন্য একটা মুরগির খোপও পায়নি। আগামী ১০০ বছরও ছাত্র-জনতার কাছে তারা আস্থা পাবে না। ছাত্র -জনতাকে হত্যাসহ গত ১৬ বছরে গুম-খুন ও নির্যাতনের বিচার হলে আওয়ামী লীগ কবরলীগে পরিণত হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের রক্তের সাথে কেউ যেন বেইমানি না করে তার জন্য সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি ।
শহীদদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের দাবি : দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন বলেন, শহীদদের জন্য আমাদের কিছু করতে হবে। ৩২ নং ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের ৬ বিঘা জমি আছে। ম্যাডামকে যেরকম ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দিয়ে সেখানে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে, শহীদদের জন্য শুধু আমাদের অনুশোচনা করলে হবে না। সেখানে (ধানমণ্ডিতে) অ্যাপার্টমেন্ট করে সব শহীদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পরিচালনায় এই স্মরণসভায় বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, বিডিআর বিদ্রোহে নিহত মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিক আহমেদসহ নির্যাতিত পরিবারের তিন সদস্য বক্তব্য রাখেন।
স্মরণ সভার শুরুতে জুলাই বিপ্লবে শহীদ ও আহত পরিবার এবং গত ১৫ বছরের গুম-খুন পরিবারের সদস্যদের আর্তনাদে চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে।
ছাত্র আন্দোলনে সাভারে শহীদ ইয়ামিনের পিতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ, এর থেকে ভারী কোনো বোঝা নেই। আর কোনো পিতা-মাতা-বোনকে এই নির্মম পরিস্থিতির শিকার যেন না হতে হয়। আমার ছেলেকে পুলিশ যেভাবে সাঁজোয়া যান থেকে টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দিয়েছে এমন দৃশ্য যেন আর দেখতে না হয়। এ সময় তিনি ‘সাঁজোয়া যান’ নিয়ে একটি লিখিত কবিতা পাঠ করেন।
টাঙ্গাইলে গুলিতে দুই চোখ হারানো হিমেলের মা বলেন, তার ছেলে কথা বলতে পারে না, দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আমি গরিব মানুষ। গুলিতে আমার ছেলের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, আমার ছেলে যেন তার একটা চোখ দিয়ে দেখতে পারে সে ব্যবস্থা করা হোক। আমি ন্যায় বিচার চাই।
শহীদ লিটন চন্দ্র শীলের মা রুবি রানী শীল বলেন, আমার ছেলেকে মেরেছে খুনী হাসিনা। আমি তার বিচার চাই।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের পুলিশের গুলিতে নিহত ইমনের ছোট ভাই সুজন বলেন, আমার ভাই টিউশনি করে আমাদের পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি নিজেও পড়াশোনা করেন। গুলিতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে ফেরত দেয়া হয়। পরে রাত ৩টার দিকে ঢাকায় নিয়ে আসার পথে পুলিশ গাড়ি থামিয়ে আবারো নির্মম নির্যাতন করে। আমার ভাই পুলিশের হাত-পা জড়িয়ে ধরলেও তারা ক্ষমা করেনি। আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, হত্যাকারীদের বিচার যেন দেশের মাটিতে দেখতে চাই। আমরা তাদের ফাঁসি চাই।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সাবেক বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ বলেন, গত ১৫ বছরে স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট খুনী হাসিনা যত গুম খুন করেছে, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলার মাটিতে হবে ইনশাআল্লাহ। সম্প্রতি একটি অডিও রেকর্ডে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি নাকি চট করে বাংলাদেশে ঢুকবেন। আমরাও রেডি আছি, এবার স্বজন হারানোর বেদনার গল্প আমরা আপনাকে শোনাবো।
এর আগে দুপুর থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে পূর্ব ঘোষিত সমাবেশে অংশ নিতে শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা আওয়ামী স্বৈরাচারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগানে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ মুখরিত করে তোলেন। সমাবেশের শুরুতে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পীরা। আন্দোলনের দিনগুলোর ভয়াবহ চিত্র মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেন অভিনয় শিল্পীরা।
স্মরণসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, আমান উল্লাহ আমান, আফরোজা খান রীতা, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, শিমুল বিশ্বাস, ফজলুল হক মিলন, শিরিন সুলতানা, রাকিবুল ইসলাম বকুল, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, ছাত্র দলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব, নাছির উদ্দীন নাছিরসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement