১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
বিদ্যুৎখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি-২

জ্বালানির নিশ্চয়তা নেই তবুও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

৯ হাজার কোটি টাকা ঋণের দায় জনগণের ঘাড়ে
-

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যেন অনিয়মের মহোৎসব চলে। আঁতকে উঠার মতো অনিয়মের চিত্র বের হয়ে আসছে একের পর এক। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজন জ্বালানি। কিন্তু গ্যাসের কোনো নিশ্চয়তা বিধান করা হয়নি। বসানো হয়নি কোনো পাইপ লাইন। অথচ শুধু কমিশন বাণিজ্যের জন্য খুলনার খালিশপুর রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াটের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ ৮২ শতাংশ শেষ হয়েছে। ৯ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থই ব্যয় হয়ে গেছে। কিন্তু গ্যাসের কোনো ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলতি বছরেই শেষ হবে। তবে জ্বালানির অভাবে এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে না। অথচ ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণের সুদ আসলের কিস্তি টানতে হবে। আর এ জন্যই বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক লোকসান বেড়ে যাচ্ছে। এ লোকসান সমন্বয় হচ্ছে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ও জাতীয় বাজেট থেকে ভর্তুকির মাধ্যমে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকার প্রাথমিক জ্বালানির নিশ্চয়তার জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনের জন্য অতি উৎসাহী ছিলেন এ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দায়মুক্তি আইনের মাধ্যমে বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়া হয়েছে একের পর এক। শেখ হাসিনা প্রশাসন তার টানা তিন মেয়াদে ৮২টি আইপিপি এবং ৩২টি রেন্টাল-পাওয়ার প্ল্যান্টের অনুমোদন দিয়েছে। আর এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার বিপরীতে কোনো বিদ্যুৎ পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, খুলনা রুপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় আরো দুই বছর বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয। এরই মধ্যে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির ভৌত অবকাঠামোর কাজ এরই মধ্যে ৮২ শতাংশ শেষ হয়েছে। চলতি বছরেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হবে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য জ্বালানির কোনো নিশ্চয়তা বিধান করা হয়নি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়ন করা হবে। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির অধীনে প্রকল্পটির কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গ্যাসের অভাবে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন পেছানো হয়েছে আগামী ২০২৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। গ্যাসের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। এ ব্যবস্থা করা না গেলে চুক্তি অনুযায়ী প্ল্যান্টের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে সরকারকে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ কম। এ পর্যন্ত ১২ হাজার মেগাওয়াটের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যার অর্ধেকেই গ্যাসের অভাবে অলস বসে আছে। এখান থেকে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। এ কারণে লোকসান বেড়ে যাচ্ছে। আর এ লোকসান সমন্বয় করা হচ্ছে দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়িয়ে।

সম্প্রতি খুলনার বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমরা শুধু শুনে আসছি, আমাদের জিডিপি বাড়ছে। আমরা নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। এখন দেখা যাচ্ছে, এটা উন্নয়নের ভ্রান্তি। এই পাওয়ার প্ল্যান্ট হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকায়। এটাও জিডিপি বাড়িয়েছে। কিন্তু এই পাওয়ার প্ল্যান্ট তো শিগগির কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এই প্রকল্পটা কী হওয়া উচিত ছিল? আমরা আগে থেকেই জানি, এখানে গ্যাস আসা কঠিন। তাহলে কার স্বার্থে এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলো। কার স্বার্থে ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হলো; কিন্তু মানুষ তো কোনো উপকার পাচ্ছে না। নির্মাণের আগে এটা বন্ধ করা যেত। এখানে তো আমরা ১৬ থেকে ১৭ মেগাওয়াটের সোলার প্ল্যান্ট করতে পারতাম। এই প্ল্যান্ট চালাতে এখন বিভিন্ন অপশন খুঁজতে হবে। পারশিয়ালি চালানো যায় কি না, পরীক্ষা করা হবে। জাতীয় উন্নয়নে সম্পদের অপচয়ের চেয়ে না হওয়াই ভালো ছিল।

বিগত সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লুটপাটের সঠিক চিত্র উদঘাটন এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বিগত সরকারের সময় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, অনিয়মের মহোৎসব হয়েছে।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের অর্থ লোপাট হয়েছে, যা খুঁজে বের করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে একজন বিচারপতিকে প্রধান করে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জ্বালানি বিভাগের কোনো মানুষ এখানে থাকবে না। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement