ড. ইউনূসের মেগাফোন কূটনীতিতে বিস্মিত বিরক্ত ভারত
- বিবিসি
- ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫২
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলন ও বিক্ষোভের মুখে দীর্ঘ ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর দায়িত্ব নেয় ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। হাসিনা সরকার ভারতের মদদপুষ্ট ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিল। ফলে এদেশের সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী মনোভাব তৈরি হয়। অন্তর্বর্তী সরকারও ভারতের সাথে বাংলাদেশের করা বিভিন্ন চুক্তি ক্ষতিয়ে দেখবে বলে ঘোষণা করেছে এবং অমীমাংসিত অনেক বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তির তাগাদা দিয়ে আসছে। এতে দৃশ্যত বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। ভারত একদিকে তাদের দেশে হাসিনার অবস্থান নিয়ে বিরক্তিকর অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার ভারতকে অবাক করেছে।
বিবিসির আনবারাসান এথিরাজন জানার চেষ্টা করেছেন, এই দুই দেশের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে দুই দেশের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। তার ক্ষমতায় থাকার সময়টি ভারতের নিরাপত্তার জন্যও সুবিধাজনক ছিল। কারণ শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত কিছু ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দমন করেছিলেন এবং সীমান্ত নিয়ে কিছু বিরোধও নিষ্পত্তি করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ভারতে হাসিনার অবস্থান নেয়া এবং তিনি সেখানে কত দিন থাকবেন সে বিষয়েও কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকায় দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো রাখার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলেছে। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ড. ইউনূসের গত সপ্তাহের এক সাক্ষাৎকারে।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, দিল্লিতে থাকার সময় শেখ হাসিনাকে যেন রাজনৈতিক বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত রাখা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত যদি তাকে রাখতেই চায়, তাহলে শর্ত হচ্ছে তাকে চুপ থাকতে হবে।’
শেখ হাসিনা দিল্লিতে যাওয়ার পর যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তা বাংলাদেশে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, ড. ইউনূস হয়তো সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। ১৩ আগস্ট ওই বক্তব্যে ন্যায়বিচার দাবি করে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, হত্যা ও ভাঙচুরের সাথে জড়িতদের চিহ্নিহ্নত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যদিও এরপর থেকে শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে আর কোনো বিবৃতি দেননি।
অপরদিকে জুলাই ও আগস্টে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের ভেতরে দাবি জোরালো হচ্ছে।
ড. ইউনূস সাক্ষাৎকারে আরো বলেছেন যে, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একসাথে কাজ করতে হবে। দুই দেশের সম্পর্ক এখন ‘নিম্ন পর্যায়ে’ আছে বলেও তিনি বর্ণনা করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে কর্মকর্তারা ‘হতাশ’ বলে জানা গেছে।
এক ভারতীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কী ঘটছে সেগুলোর দিকে ভারত নজর রাখছে এবং ঢাকা থেকে সরকার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কী ধরনের বক্তব্য ও বিবৃতি দিচ্ছে, সেগুলোর দিকে ভারত লক্ষ রাখছে।’
ড. ইউনূসের এ ধরনের বক্তব্যকে ভারতের সাবেক কূটনীতিকরা ‘মেগাফোন কূটনীতি’ হিসেবে বর্ণনা করছেন এবং বিষয়টিতে তারা বিস্মিত হয়েছেন। ড. ইউনূস মিডিয়ার মাধ্যমে বিতর্কিত দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছেন বলেও তারা মনে করেন।
ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কথা বলার জন্য এবং দুই দেশের সব উদ্বেগের জায়গাগুলো নিয়েও আলোচনা করার জন্য ভারত তাদের প্রস্তুত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে।’
অবসরপ্রাপ্ত এই কূটনীতিক বলেছেন, এই সমস্যাগুলো নিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করা প্রয়োজন এবং কিসের ভিত্তিতে ড. ইউনূস দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘নিম্ন পর্যায়ে’ রয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিবিসি বাংলার মুকিমুল আহসানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভারতীয় নেতারা কি কোনো মিডিয়ার সাথে কথা বলেন না? ড. ইউনূসকে যদি নির্দিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি অবশ্যই তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন। আপনি যদি সমালোচনা করতে চান তবে যেকোনো বিষয়েই সমালোচনা করতে পারেন।’
কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ড. ইউনূস টেলিফোনে কথা বললেও এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়নি। ভারতে একটি বড় ধরনের ঐকমত্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে যে শেখ হাসিনা যত দিন না অন্য কোনো দেশে প্রবেশের অনুমোদন পাচ্ছে, তত দিন তিনি ভারতে থাকতে পারবেন।
তবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, বিক্ষোভের সময় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেহেতু তাকে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান আসামি করা হয়েছে আমরা তাকে আইনিভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করব।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানালেও শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা কম।
ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা আরেক ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, তিনি এখানে ভারতের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন। আমরা যদি আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুর প্রতি মৌলিক সৌজন্যতা না দেখাই, তাহলে ভবিষ্যতে কেন কেউ আমাদের বন্ধু হওয়াটা গুরুত্ব সহকারে নেবে?
ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর কাছে না পৌঁছানোর জন্যও দিল্লির সমালোচনা করেন।
ইউনূস বলেন, ‘একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে যে সবাই ইসলামপন্থী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইসলামপন্থী , বাকি সবাই ইসলামপন্থী এবং তারা এই দেশকে আফগানিস্তানে পরিণত করবে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র শেখ হাসিনার হাতেই নিরাপদ। ভারত এই ব্যাখ্যাতেই বিমোহিত হয়ে আছে।’
কিন্তু ভারতীয় বিশ্লেষকরা ভিন্ন মত পোষণ করেন। বীনা সিক্রি বলেন, আমি এই বক্তব্যের সাথে একেবারেই একমত নই। বাংলাদেশে আমাদের হাইকমিশনাররা কোনো লেবেল না দিয়েই সব রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলে থাকেন।’
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ঢাকা ও দিল্লির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ওই সময় ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য ঢাকাকে অভিযুক্ত করেছিল দিল্লি। যদিও বিএনপি সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।
তবে বাংলাদেশের অনেকেই উল্লেখ করেছেন যে ভারতের উচিত বিএনপির সাথে যোগাযোগ করা। সামনে যখনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক না কেন এই দলটি জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা আমাদের সাথে দেখা করেননি। আমি কারণ জানি না।’ উল্টো বিএনপির সাথে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা নিয়মিত বৈঠক করছেন।
শেখ হাসিনার পতনের পরের দিনগুলোয় নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়। এতে সন্দেহভাজন ইসলামপন্থীদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ভারত ইতোমধ্যে হিন্দুদের ওপর হামলার খবরে বেশ কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত কয়েক সপ্তাহে, স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন মাজারেও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে সুন্নি মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কট্টরপন্থীরা মাজার ও সমাধিকে ‘ইসলামসম্মত নয়’ বলে মনে করে।
বাংলাদেশের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, যারা ধর্মীয় স্থানকে টার্গেট করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে ইসলামী কট্টরপন্থীরা যদি বাংলাদেশে একটি শক্ত অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সেটা যত ছোটই হোক না কেন, তা দিল্লির জন্য বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একজন দণ্ডিত ইসলামী জঙ্গিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তারও আগে নরসিংদীর কারাগার থেকে সন্দেহভাজন ৯ জঙ্গি পালিয়ে যায়। যদিও তাদের মধ্যে চারজনকে পরে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন গত মাসে জামিনে মুক্ত হন। শেখ হাসিনা সরকার ২০১৬ সালে এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে।
২০১৫ সালে এক ব্লগারকে হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে আরো কিছু মামলা বিচারাধীন থাকায় তিনি কারাগারেই ছিলেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা