১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বাম চোখে কিছু দেখেন না বেলাল, গুলি একটা রয়েই গেছে

বাম চোখে কিছু দেখেন না বেলাল, গুলি একটা রয়েই গেছে -

অপারেশনের পরও বাম চোখের পেছনের গুলিটা বের করা যায়নি, গুলিটা চোখ ভেদ করে পেছনে গিয়ে আটকে আছে। বাম চোখটা নষ্ট করে দিয়েছে, এই চোখে এখন কিছুই দেখা যায় না। ডান চোখটাও যে ভালো তা বলা যাবে না, ঝাপসা দেখা যায় সবকিছু। চিকিৎসকরা বলেছেন, ওই গুলিটা থেকেই যাবে, এটা বের করা সম্ভব হবে না। এই গুলিটা নিয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে বেলাল হোসেনকে (২৬)।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম থানার পোস্তা গ্রামের বাসিন্দা বেলাল হোসেন মৃত আব্দুল জলিলের ছেলে। পেশায় ট্রাক ড্রাইভার, সর্বশেষ ঢাকা মেট্রো ট ২৪ ১৮৩৮ নম্বর গাড়ি চালাতেন। ট্রাকের মালিকের সাথে বনিবনা না হওয়ায় ট্রাক ছেড়ে আশুলিয়ায় থাকতে শুরু করেন। প্রথমে কোনো একটি গাড়ি চালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু গাড়ি না পেয়ে গার্মেন্ট কারখানায় চাকরির চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু এর মধ্যেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশ যেভাবে হত্যা করেছে তাতে হাসিনা ও তার পুলিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মন। বেলাল হোসেন জানান, আশুলিয়ায় জানাশোনা তেমন কেউ নেই, আন্দোলন যারা করেছে তাদের কেউ পরিচিত নন। তবু গত ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সাথে মিশে যান ট্রাক ড্রাইভার বেলাল। ওই দিন বিকেলে আশুলিয়া থানার সামনে বিক্ষোভ মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন বেলাল। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিচতলায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভর্তি হয়েছিলেন শেরেবাংলা নগরের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। সেখান থেকে চোখের জটিল সমস্যাগ্রস্ত যে রোগীদের এখানে পাঠানো হয়েছে তাদের একজন বেলাল।

এই প্রতিবেদককে বেলাল বলেন, সেদিন মেসে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ হাসিনার বিরুদ্ধে সেøাগান শুনলাম, কোনো চিন্তা না করে বেরিয়ে পড়লাম আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দিতে। আমি রাজনীতি বুঝি না, আমার কাছে রাজনীতিকে মনে হয় কিছু লোকের হঠাৎ বড় লোক (ধনী) হওয়ার হাতিয়ার। এ কারণে এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহও কোনো দিন ছিল না। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি এই মহিলা জোর করে ভোট করে ক্ষমতায় আছে। ২৬ বছর বয়সে একবারও ভোট দিতে পারিনি। কেউ এই মহিলার বিরুদ্ধে কথাও বলতে পারে না। দিনে কেউ প্রতিবাদ করলে রাতের বেলা পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, গুম হয়ে গেছে অনেকেই। সে কারণে ছাত্ররা যখন আন্দোলনে নামে তাদের প্রতি আমার সব সহানুভূতি ছিল। জুলাই মাসে যে আন্দোলন গেল তাতে নামবো নামবো করে নামা হয়নি। পরে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সাথে আশুলিয়া থানার সামনে মিশে যাই আন্দোলনে। কেউ ডাকেনি অথবা কেউ এসে উদ্বুদ্ধও করেনি আন্দোলনে যেতে। নিজে থেকেই গিয়েছি, মরে গেলে খুব একটা আফসোস ছিল না। গুলি খেয়ে অনেকেই মরে গেছেন, আমিও না হয় মরলাম কিন্তু এই অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই মরলাম এই সান্ত্বনা ছিল মনে মনে। এমনিতেই আমার বাবা-মা কেউ নেই যে কান্না করবে, হাসপাতালেও আমার পরিচর্যা করার কেউ নেই, নিজেই সবকিছু করি। শুধু একজন ভাই আছে কিন্তু তিনিও বিদেশে। বেলাল জানান, আশুলিয়ায় একজনের সাথে আমার কিছুটা পরিচয় ছিল। কিন্তু এখন সে আর ফোন ধরে না। হয়তো আন্দোলনে গিয়ে মারাও যেতে পারে, জানি না।
চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসকরা কপালের গুলি বের করে দিয়েছেন। পরে তারাই এ হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) পাঠিয়েছেন। এখানে বামচোখে অপারেশন হয়েছে কিন্তু চোখের পেছনে যে গুলি ঢুকে আছে সেটা বের করতে পারেননি তারা। শরীরে আরো অনেকগুলো ছররা গুলি ঢুকে আছে, কয়টা জানি না। বাম বাহুতে একটা গুলি ছিল, আমি নিজেই নখ দিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ফেলেছি।
এখান থেকে গিয়ে কী করবেন জানতে চাইলে বেলাল বলেন, কী করব জানি না। আমি আর ট্রাক চালাতে পারব না, আমার তো একটা চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তবে কিছু টাকা পেলে ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারব। কেউ কি দেবেন আমাকে কিছু টাকা? এখানে সব চিকিৎসা ফ্রি হচ্ছে, শুনেছি এটা ইউনূস স্যারের নির্দেশে হচ্ছে। কিন্তু ইউনূস স্যার কি আমাকে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দেবেন যেন পরে কিছু করে খেতে পারি?

 


আরো সংবাদ



premium cement