১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

গাজায় ইসরাইলি হামলায় আরো ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত

-

- পশ্চিমতীরে গাড়ি হামলায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসরাইলি সৈন্য নিহত
- ব্যর্থতার দায় নিয়ে ইসরাইলি গোয়েন্দা প্রধানের পদত্যাগ
- ইসরাইলকে আরো ১৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের অস্ত্র দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বর্বর হামলায় আরো ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৪১ হাজার ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরো ৯৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। গতকাল শুক্রবার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ইসরাইলের সামরিক বাহিনী গাজায় তাদের বর্বর আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে এবং আরো ৪০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এ ছাড়া গাজায় জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত একটি স্কুলে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১৮ জনকে হত্যার দায়ে ইসরাইল আন্তর্জাতিক নিন্দার সম্মুখীন হয়েছে। ওই হামলায় নিহতদের মধ্যে জাতিসঙ্ঘের ছয় সহায়তা কর্মীও রয়েছেন। এদিকে পৃথক খবরে তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদোলু বলেছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান হামলায় কমপক্ষে আরো ৩৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪১ হাজার ১১৮ জনে পৌঁছেছে বলে বৃহস্পতিবার অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিরলস এই হামলায় আরো অন্তত ৯৫ হাজার ১২৫ জন ব্যক্তিও আহত হয়েছেন। মন্ত্রণালয় বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসনে ৩৪ জন নিহত এবং আরো ৯৬ জন আহত হয়েছেন। অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন কারণ উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মনে করছে, গাজা উপত্যকাজুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন। মূলত গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইসরাইলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসঙ্ঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সঙ্কটের মধ্যে গাজার সবাই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।

পশ্চিম তীরে সাংবাদিকরা ইসরাইলি হামলার শিকার : জাতিসঙ্ঘ বিশেষজ্ঞ
তা ছাড়া অধিকৃত পশ্চিম তীরে সাংবাদিকরা ইসরাইলি বাহিনীর হামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। জাতিসঙ্ঘ বিশেষজ্ঞরা ‘যুদ্ধাপরাধ’ নিয়ে সংবাদ কভার করা বন্ধের প্রচেষ্টা চালানোয় ইসরাইলকে অভিযুক্ত করেছে। আগস্টের শেষ দিকে ইসরাইল পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আগ্রাসন শুরু করে এবং সেখানে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি আইরিন খান এবং ফ্রান্সেসকা আলবানিজ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই মাসে জেনিন ও তুলকারেম শহরে তিনটি ঘটনায় ইসরাইলি সেনারা ‘সাংবাদিক বা তাদের যানবাহন’ লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এ সময় সেখানে সাংবাদিকরা সামরিক অভিযান ও বেসামরিক হতাহতের বিষয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিল। ইসরাইলি বাহিনী জেনিন ও তুলকারেমে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির লক্ষ্য করে হামলা চালায়। তাদের দাবি, এসব এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অত্যন্ত সক্রিয়। খবরে বলা হয়, প্রেস জ্যাকেট পরা সত্ত্বেও সেখানে ইসরাইলি হামলায় চারজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ৩ সেপ্টেম্বর জেনিনে এমন একটি ঘটনা এএফপির এক সাংবাদিক প্রত্যক্ষ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমরা বেআইনিভাবে দখলকৃত পশ্চিম তীরে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হয়রানির তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধমূলক প্রতিবেদন তৈরিতে বাধা দেয়ার জন্য ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অমার্জিত প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে পশ্চিম তীরে ২৯ জন সাংবাদিককে ইসরাইলি বাহিনী আটক করেছে। এ সময়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। ইসরাইল ১৯৬৭ সাল থেকে পশ্চিম তীর দখল করে রেখেছে এবং গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে ইসরাইল ব্যাপক আগ্রাসন চালিয়ে আসছে।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এবং বসতি স্থাপনকারীদের হাতে পশ্চিম তীরে কমপক্ষে ৬৬৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
পশ্চিম তীরে গাড়ি হামলায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসরাইলি সৈন্য নিহত : এনডিটিভি সূত্রে জানা যায়, পশ্চিম তীরে গাড়ি হামলায় এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসরাইলি সৈন্য নিহত হয়েছেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, স্টাফ সার্জেন্ট গেরি গিডিয়ন হাঙ্গল নফ হাগালিলের বাসিন্দা এবং কেফির ব্রিগেডের নাহশোন ব্যাটালিয়নের একজন সৈনিক ছিলেন। বৃহস্পতিবার কমিউনিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, পশ্চিম তীরের বেইট এল বসতির কাছাকাছি একটি গাড়ির ধাক্কাধাক্কিতে বেনি মেনাশে সম্প্রদায়ের ২৪ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসরাইলি সৈনিক নিহত হয়েছেন। তিনি স্টাফ সার্জেন্ট গেরি গিডিয়ন হাঙ্গল নফ হাগালিলের বাসিন্দা এবং কেফির ব্রিগেডের নাহশোন ব্যাটালিয়নের একজন সৈনিক ছিলেন।
সম্প্রদায়ের সদস্যরা পিটিআইকে বলেছেন যে, তারা বুধবার আসাফ জংশনের কাছে ‘এক তরুণের প্রাণহানির খবরে হতবাক হয়েছেন’। হাংহাল ২০২০ সালে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে ইসরাইলে অভিবাসী হন। প্রায় ৩০০ বেনেই মেনাশে যুবক বর্তমান যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানা গেছে। তাদের বেশির ভাগই যুদ্ধ ইউনিটে কাজ করছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর এবং মিজোরাম থেকে আগত বেনি মেনাশেহ প্রাচীন যুগের ‘হারানো উপজাতিদের’ একটি মেনাশেহ ইসরাইলীয় গোত্র থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। শ্লোমো আমার, সেফার্ডিক প্রধান রাব্বি, তাদেরকে ২০০৫ সালে মেনাশেহের বংশধর বলে ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, তারা ‘হারানো গোত্রের’ সদস্য হিসেবে ইসরাইলে তাদের অভিবাসনের পথ প্রশস্ত করেছে। বেনিই মেনাশেহ সম্প্রদায়ের প্রায় ৫ হাজার সদস্য ইসরাইলে অভিবাসী হয়েছেন বলে জানা গেছে, যার মধ্যে গত পাঁচ বছরে প্রায় এক হাজার ৫০০ জন রয়েছে। আরো পাঁচ হাজার ৫০০জন এখনো ভারতে বাস করে এবং অভিবাসনের অপেক্ষায় রয়েছে। নোফ হাগালিল মেয়র, রনেন প্লট বলেছেন, নফ হাগালিল শহর স্টাফ সার্জেন্ট হাঙ্গলকে হারানোর জন্য শোক প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, তিনি শোকাহত। গিডিয়ন ছিলেন বেনি মেনাশেহ সম্প্রদায়ের সদস্য, যেটি আমার হৃদয়ের খুবই প্রিয়। তারা নম্র এবং দেশপ্রেমিক মানুষ।
ব্যর্থতার দায় নিয়ে গোয়েন্দা প্রধানের পদত্যাগ : ইসরাইলের এলিট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ ‘ইউনিট ৮২০০’-এর প্রধান পদত্যাগ করেছেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী বৃহস্পতিবার বলেছে যে, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য একটি অভিজাত গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান পদত্যাগ করবেন। সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘৮২০০ ইউনিটের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়োসি সারিয়েল তার কমান্ডার এবং অধস্তনদের তার পদত্যাগ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। এই অফিসার অদূর ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীতে তার ভূমিকার ইতি টানবেন। মর্যাদাপূর্ণ ও গোপনীয় ইউনিট ৮২০০ ডিকোডিং এবং ইন্টারসেপ্ট ও অন্যান্য সঙ্কেত বুদ্ধিমত্তা বিশ্লেষণের দায়িত্বে রয়েছে। ৭ অক্টোবরের পরিপ্রেক্ষিতে, ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতর একটি সঙ্কটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। যার ফলে এর কমান্ডার মেজর জেনারেল অ্যাহারন হালিভা ২০২৪ সালের এপ্রিলে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সেনাবাহিনী তখন বলেছিল যে, হালিভা ৭ অক্টোবরের হামলা বানচাল করতে অধিদফতরের ব্যর্থতার জন্য তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ইসরাইলি মিডিয়া সারিয়েলের পদত্যাগপত্রের একটি অনুলিপি সম্প্রচার করেছে, যাতে তিনি ৭ অক্টোবর তাদের উপর অর্পিত মিশনটি পূরণ না করার জন্য ‘ক্ষমা’ চেয়েছিলেন। জুন মাসে পাবলিক ব্রডকাস্টার কান ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনিট ৮২০০ দ্বারা প্রস্তুত করা একটি গোয়েন্দা ব্রিফের অস্তিত্ব প্রকাশ করে, যা হামলার জন্য হামাসের প্রস্তুতি সম্পর্কে সামরিক কর্মকর্তাদের সতর্ক করেছিল। কান বলেন, ইউনিট ৮২০০ নথিতে আটক করার জন্য অভিজাত হামাস যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষিণ ইসরাইলে সামরিক অবস্থান ও ইসরাইলি সম্প্রদায়ের উপর অভিযান চালানোর পরিকল্পনার বিবরণ রয়েছে।
ইসরাইলকে আরো ১৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের অস্ত্র দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র : গাজায় ইসরাইলের চলমান নৃশংসতা ও যুদ্ধবিরতির তীব্র দাবির মধ্যেই দেশটির কাছে আরো ১৬ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে আনাদোলু এজেন্সি।
বৃহস্পতিবার মার্কিন ডিফেন্স সিকিউরিটি কো-অপারেশন এজেন্সি জানিয়েছে, এই সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির চালান ২০২৭ সালে শুরু হবে বলে কংগ্রেসকে অবহিত করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শক্তিশালী রাখা এবং আত্মরক্ষা সক্ষমতা বিকাশ ও বজায় রাখতে ইসরাইলকে সহায়তা করা মার্কিন জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যাবশ্যক। এই প্রস্তাবিত বিক্রয় সেই লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ’।


আরো সংবাদ



premium cement