১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

হাসিনা পালিয়েছে, কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তিদের ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত

-

আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে নিখোঁজ ১৫০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পেরেছেন। জোরপূর্বক নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেক পরিবার তাদের স্বজনদের সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্যের জন্য অপেক্ষা করছে।
গত ১০ আগস্ট, বাংলাদেশে বলপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিবেদিত একটি অধিকার গোষ্ঠী মায়ের ডাক, সামরিক গোয়েন্দা সদর দফতরে, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) কাছে ১৫৮ জন নিখোঁজ ব্যক্তির একটি তালিকা জমা দিয়েছে।
নিখোঁজদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতা আতাউর রহমান যিনি ২০১১ সালে ঢাকা থেকে অপহৃত হন। তার স্ত্রী নাদিরা সুলতানা এবং তাদের সন্তানরা তার ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। গত ১১ আগস্ট ঢাকায় ডিজিএফআই সদর দফতরের বাইরে স্বামীর তথ্যের দাবিতে বিক্ষোভে নিখোঁজদের পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে যোগ দেন সুলতানা। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে এখনো বিশ্বাস করে তার বাবা বেঁচে আছেন। আমি তাকে বলেছিলাম আমি তাকে ফিরিয়ে আনব, আমার সন্তানরা তাদের বাবাকে ফিরে পেতে চায় এবং আমি আমার স্বামীকে ফিরে পেতে চাই।’
মুর্শেদা বেগমের স্বামী, বিএনপির আরেক সদস্য ফারুক হোসেন, ২০১২ সালে অপহৃত হন। তিনি পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার কাছে একাধিক প্রতিবেদন দাখিল করেন, কিন্তু হোসেন সম্পর্কে কোনো সহায়তা বা তথ্য পাননি। বেগম ও তার দুই মেয়েও ডিজিএফআই কার্যালয়ের বাইরে হোসেনের ছবি হাতে নিয়ে বিক্ষোভ করেন। আল জাজিরাকে তিনি জানান, ‘আমাদের জীবন অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।’
গত সপ্তাহে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন্স ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সে যোগদানে স্বাক্ষর করেছে, যা এই ধরনের গুমের অবসানের লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘের একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন।
মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে গুম সমস্যা সমাধানে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন। তুলি আল জাজিরাকে বলেন, ‘এই নিখোঁজের গুরুতর অন্যায়কে অবশ্যই উন্মোচন এবং বিচার করতে হবে। অনেক পরিবার এখনো তাদের প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের সন্ধান পেতে চায়।’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ‘স্বৈরাচারী’ শাসনামলে জানুয়ারি ২০০৯ এবং জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের হাতে জোরপূর্বক নিখোঁজ হওয়া শীর্ষ বিরোধী ব্যক্তিত্ব এবং কর্মীসহ ৭০০ জনেরও বেশি ব্যক্তি ছিলেন। এদের মধ্যে ৮৩ জনকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে কিছু নিরাপত্তা বাহিনীর ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন আর এখনো ১৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন।
ভাগ্যবান যারা ফিরতে সক্ষম হন : বাংলাদেশী পাহাড়ি অধিকার কর্মী মাইকেল চাকমার জন্য, সামরিক গোয়েন্দাদের পরিচালিত গোপন কারাগার ‘আয়নাঘরে’ তার পাঁচ বছরের বন্দিত্বের প্রতিটি দিন ছিল বেদনাদায়ক এবং সীমাহীন হতাশায় ভরা। মুক্তির পর আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি রক্ষীদের কাছে সময় চাইতাম যাতে আমি প্রার্থনা করতে পারি, কিন্তু তারা কখনই উত্তর দেয়নি, মাঝে মাঝে আমি আমার সেলের বাইরে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর এবং চিৎকার শুনতে পেতাম। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি আমার মতো আরো বন্দী আছে। এটি একটি সম্পূর্ণ কার্যকর কারাগার ছিল।
মাইকেল চাকমার মতো কাসেমকেও রাতের আধা ঘণ্টা চোখ বেঁধে রাখার নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তাকে ঢাকার একটি মহাসড়কের কাছে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল, যেখান থেকে তিনি এক ঘণ্টা হেঁটেছিলেন যতক্ষণ না তিনি একটি দাতব্য ক্লিনিকের সামনে পৌঁছতে পারেন যেটির ট্রাস্টি ছিলেন তার বাবা মীর কাসেম আলী। মীর আহমদ বিন কাসেম হলেন মীর কাসেম আলীর ছোট ছেলে, যিনি ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের সময় হাসিনার সরকার কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েক ডজন জামায়াত নেতার অন্যতম।
কাসেম বলেন, ‘আমি ভাগ্যবান বোধ করছি যে আমি বেঁচে আছি, কারাগারের ভিতরে, আমি আমার প্রিয়জনকে আবার দেখার আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরিস্থিতি এতটাই অমানবিক ছিল যে এটি কোনো আশার অনুভূতি কেড়ে নিয়েছিল। আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা মৃতদেহের মতো বেঁচে আছি।
দুঃসহ সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘কোনো জানালা ছিল না এবং আমার সময় বলার কোনো উপায় ছিল না, বা এটি দিন না রাত। আমি একটি অন্ধকার, ঘেরা জায়গায় ছিলাম এবং যখন আলো জ্বালানো হলো তা আমার চোখকে ধাঁধিয়ে দেয়। অধিকাংশ সময়, আমাকে হাতকড়া এবং শিকল পরানো হতো।’
আয়েশা খাতুন তার ছেলে কাসেম সম্পর্কে আল জাজিরাকে বলেছেন, আরমান (কাসেমের ডাকনাম) বেঁচে আছে কি না আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। সেই অস্থিরতার প্রতিটি মুহূর্ত অনন্তকালের মতো অনুভূত হয়েছিল। কাসেমের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার এবং তাদের দুই মেয়ের সেই দিনের কথা মনে আছে যখন একদল লোক তাদের ঢাকার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিল এবং কাসেমকে তাদের সাথে যেতে বলেছিল। আক্তার আল জাজিরাকে বলেন, আমাদের মেয়েরা কাঁদছিল এবং তাদের বাবার জামাকাপড় জড়িয়ে ধরেছিল। আগামী আট বছর তিনি নিখোঁজ হবেন সেদিন তা আমরা কল্পনাও করিনি। গত মাসে যখন খাতুন তার ছেলের সাথে আবার মিলিত হন, তখন তিনি বলেন যে এটি পরাবাস্তব মনে হয়েছিল। এটি একটি স্বপ্নের মতো অনুভূত হয়েছিল এবং কিছু সময়ের জন্য, আমি নিশ্চিত ছিলাম না এটি সত্যিই ঘটছে কি না।’
এই বন্দীদের মধ্যে একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান, যিনি দুই বছর গোপন কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে আমার সামাজিক মিডিয়া পোস্টগুলোর জন্য লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল যেখানে আমি হাসিনা সরকারের দুর্নীতি ও সহিংসতার জন্য কঠোর সমালোচনা করেছি, আয়নাঘর শুধুমাত্র একটি জায়গা নয়। এখানে বেশ কয়েকটি গোপন কারাগার রয়েছে যা সম্মিলিতভাবে আয়নাঘর নামে পরিচিত। এগুলো মূলত উচ্চমূল্যের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য বন্দীদের রাখার জন্য সেনাবাহিনীর গোয়েন্দাদের দ্বারা পরিচালিত গোপন একটি নেটওয়ার্ক।’ তাকে অপহরণ ও আটকের বিষয়ে নীরব থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাসিনুর বলেন, ‘তারা স্পষ্ট এবং সরাসরি হুমকি দিয়েছে: তারা শুধু আমাকে আবার অপহরণ করবে না, তারা আমার পরিবারের সদস্যদেরও ক্ষতি করবে,’ জানান হাসিনুর।


আরো সংবাদ



premium cement