২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
সতর্ক থাকার আহ্বান নীতিনির্ধারকদের

পোশাক খাতকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা

-

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ১৫ বছর ৭ মাসের দুঃশাসনে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা, গুম, জেল জরিমানাসহ আয়নাঘর নামক ভয়াবহ বন্দীশালায় আটকে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের মতো দেশের প্রায় সকল পেশাজীবী সংগঠনগুলোতেও দিনের ভোট রাতে নিয়ে তার লুটপাটের সহযোগিতাকারী অনুগত পছন্দের লোকদের নির্বাচিত করা হতো। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএও। ভুয়া ভোটার সৃষ্টি করে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে গত দেড় দশকে স্বৈরাচারের দোসররাই রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলে নিয়েছে। সাধারণ ভোটারদের ভোটারাধিকার প্রয়োগ করার কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি। এই সংগঠনটি দীর্ঘ দিন একটি স্বার্থান্বেষী ও স্বৈরাচারী শাসকের ঘনিষ্ঠ কতিপয় ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে এর স্বাভাবিক কার্যক্রম আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৯ মার্চ বিজিএমইএ নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ক্ষমতায় আসে, যা সাধারণ সদস্যদের মনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। স্বৈরাচারী হাসিনা গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সাধারণ ব্যবসায়ীরা এখন তাদের এ শীর্ষ সংগঠনের সংস্কার দাবি করছেন। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ অবিলম্বে ভেঙে দিয়ে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেয়াসহ ৭ দফা দাবি জানিয়েছেন বিজিএমইএর সাধারণ সদস্যরা।
পোশাক খাতের সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতে, দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে এই পোশাক শিল্প থেকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে এ সেক্টরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অথচ গত দেড় দশকে স্বৈরাচারের দোসররা ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে এ খাতটিকে একটি দুর্বৃত্তায়নের আখড়ায় পরিণত করেছে। এখন ছাত্র জনতার জীবন ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত দ্বিতীয়বারের স্বাধীনতা নস্যাত করতে লুটেরা শ্রেণী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নানা চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। পর্দার আড়াল থেকে অহেতুক ও অযৌক্তিক কিছু দাবি তুলে পোশাক খাতকে অস্থির করার চেষ্টা করছেন বলে তারা অভিযোগ করেছে।
সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পোশাক খাতের গত দেড় দশকের নেতৃত্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, খুনি, সন্ত্রাসী, অর্থ পাচারকারীদের দৌড়াত্ম্যের কাছে সাধারণ ব্যবসায়ীরা অসহায় হয়ে পাড়েছিল। বিগত ১৬ বছর এই সংগঠনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে সাবেক সভাপতি, মো: টিপু মুনশি বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলায় জেলে আছেন। সাবেক সভাপতি মো: আব্দুস সালাম মুর্শেদী ছাত্র হত্যা মামলার আসামি ও বর্তমানে পলাতক আছেন। তার মেয়ে ঐশী বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের একজন পরিচালক। সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মো: আতিকুল ইসলাম আতিক হত্যা মামলার আসামি ও পলাতক। সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক মো: সিদ্দিকুর রহমান যিনি হামলা মামলার আসামি এবং পলাতক, তার ছেলে মো: ইমরানুর রহমান বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের একজন পরিচালক। শুধু তাই নয়, বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্য বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সক্রিয় সদস্য ও পৃষ্ঠপোষক।
সাধারণ সদস্যদের অভিযোগ, নিজের কোনো কারখানা না থাকলেও বিজিএমইএ সদস্য হয়ে জোর করে ক্ষমতার দাপটে সভাপতি হন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি। স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। সাধারণ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, বিজিএমইএ পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে এস এম মান্নান কচি তার দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সংগঠনটির ক্ষমতা দখল করেন। এই কাজে সাবেক সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদী, মো: শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, মো: খশরু চৌধুরী, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম নিজ বাহিনীসহ সরাসরি অংশ নেয়। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও এ অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন বলে তাদের অভিযোগ। গত ৪ আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে এস এম মান্নান কচি ও তার সহযোগীরা ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়ন ও হত্যায় উত্তরা ও মিরপুরে বিজিএমইএর পলাতক এ সভাপতির নেতৃত্বে তার ক্যাডার বাহিনী মূল ভূমিকা পালন করে। এটি সব গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনে কয়েক শত ছাত্র-জনতা নিহত হওয়ার পরও বর্তমান বোর্ড ও সভাপতি কোনো শোকবার্তা দেয়নি। বিজিএমইএ সভাপতি ও তার বোর্ড ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন ও গণজোয়ারে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ভূমিকা পালন করায় তারা দায়িত্ব পালনের নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর সৃষ্ট সঙ্কটে কারখানা খোলা নিয়ে বিজিএমইএ পর্ষদের সঠিক কোনো নির্দেশনা ছিল না। এ ছাড়া সংগঠনটি গত কয়েক সপ্তাহে ব্যবসা পরিচালনায় কার্যকর কোনো নির্দেশনা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতি ও চরম ভোগান্তির শিকার হন। বিজিএমইএর বর্তমান পুনর্গঠিত কমিটির সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামসহ অন্যরাও পলাতক সভাপতি এস এম মান্নান কচির বোর্ডের সদস্য এবং বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগী ও আজ্ঞা-বাহক উল্লেখ করে অনন্ত গার্মেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবুল ও মাইশা ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সংস্কারসহ বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন।
তাদের উত্থাপিত দাবিগুলো হচ্ছে, সদস্যদের সাথে আলোচনা করে দলীয় প্রভাবমুক্ত ২০ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালনা বোর্ড গঠন, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে অতি দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ; সংগঠনে অতীতের সব দুর্নীতির স্বচ্ছ ও সঠিক তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন; বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিইউএফটি) বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ হাসিনার দোসর মো: শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনসহ বর্তমান বোর্ড ভেঙে নতুন বোর্ড গঠন; বিগত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিইউএফটির মো: সেলিম তালুকদারসহ নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরকে শহীদ সেলিম চত্বর ঘোষণা।


আরো সংবাদ



premium cement