২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

দিশেহারা বন্যার্ত মানুষ

ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে গোটা ফেনী। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। গৃহহীন মানুষ ছুটছেন আশ্রয়ের সন্ধানে : নয়া দিগন্ত -

- ১৭ জনের মৃত্যু, ক্ষতিগ্রস্ত ৪৫ লাখ
- প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা
- উদ্ধার তৎপরতায় সেনা মোতায়েন
- ১১ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন
- পদ্মা ও গড়াই নদীর পানিও বাড়ছে

বন্যায় বিধ্বস্ত ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ ১২ জেলায় বিপর্যয়ের কবলে লাখ লাখ পানিবন্দী মানুষ। খাদ্য, খাবার পানি ও আশ্রয়ের অভাবে দুর্গত মানুষ এখন দিশেহারা। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে অন্যান্য সূত্রে মৃতের সংখ্যা কয়েক শতাধিক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢলের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ৫০ লাখ মানুষ। এ দিকে টানা ভারীবর্ষণ ও উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলের পানিতে সৃষ্ট উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণতৎপরতা জোরদার হয়েছে। গতকাল অনেক এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় বানের পানি কমতে শুরু করেছে। সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো কোনো স্থানে পানি কিছুটা কমলেও ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লায় বন্যাপরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। গোমতি নদীর বাঁধ ভেঙে ছয় লাখ মানুষ নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বানের পানি বঙ্গোপসাগরমুখী হওয়ায় কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুরসহ এখনো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার, ত্রাণতৎপরতা, চিকিৎসা ও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের উপদেষ্টারা দুর্গত এলাকায় যাচ্ছেন এবং ত্রাণতৎপরতায় যোগ দিচ্ছেন।

গোমতি নদীর বাঁধ ভেঙে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬০ হাজার পরিবার : হাবিবুর রহমান চৌধুরী কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে বুড়িচং উপজেলার সাত ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গোমতির বাঁধ ভাঙায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। ৬০ হাজার পরিবার বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টায় এ ঘটনা ঘটে। ভাঙন এলাকার পাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাতে বাঁধ ভাঙার কারণে অধিকাংশ লোকজন ঘরবাড়িতে আটকা পড়েছে। জেলা সদরের সাথে উপজেলা সদরের প্রধান সড়কের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান। জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ওই স্থানের নিচ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা ফেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু রাত পৌনে ১২টার দিকে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। শুক্রবার সকালে প্রায় ৬০ ফুটের মতো বাঁধ ভেঙে যায়, তবে পানি বের হওয়ার সাথে সাথে ভাঙার পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।
তিনি আরো বলেন, পানি এখনো বিপদসীমার ওপরে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় ছিল ১৩৪ সেন্টিমিটার উপরে, শুক্রবার সকালে বিপদসীমার ১২৯ সেন্টিমিটার ওপরে।

বুড়িচং উপজেলার প্লাবিত গ্রামগুলো হলো বুড়বুড়িয়া, খাড়াতাইয়া, নানুয়ার বাজার, কিং বাজেহুরা, মিথিলাপুর, শিকারপুর, মহিষমারা, ইছাপুরা, পয়াত, গাজীপুর, কণ্ঠনগর, মাওরা, গোপীনাথপুর, জগৎপুর ও গোসাইপুর।
মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে তিন শতাধিক মানুষ আশ্রয় নেন। স্কুলটির নিচতলা পানিতে ডুবে যায়। রোটারিয়ান আবদুল্লাহিল বাকী তার সাথে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে স্পিডবোটের মাধ্যমে আটকা পড়া লোকজনকে উদ্ধারের কাজ করছেন। বুড়বুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী গোলাম কিবরিয়া জানান, তার বাড়িঘর সব পানিতে তলিয়ে গেছে।
বাঁধ ভাঙায় ক্ষতিগ্রস্ত দুই লক্ষাধিক মানুষ
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়ায় গোমতীর বাঁধ ভাঙায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। ভাঙা অংশ দিয়ে এখনো পানি ঢুকছে লোকালয়ে। এতে বুড়িচং উপজেলার সাথে আদর্শ সদর উপজেলার একাংশ, ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বুড়িচং উপজেলার ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন।

বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে আছে
নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে অবিরাম বৃষ্টি ও ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ১৬টি ইউনিয়নের ২৯১টি গ্রামের মধ্যে প্রায় ২৫০টি গ্রামের তিন লক্ষাধিক মানুষের বাড়িঘর পানিতে ভেসে গিয়ে বন্যা আক্রান্ত হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষ করে ডাকাতিয়া নদী তীরবর্তী বাঙ্গড্ডা, রায়কোট উত্তর, দক্ষিণ ইউনিয়ন, মৌকরা, ঢালুয়া, বক্সগঞ্জ, সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের মানুষ বন্যাকবলিত অবস্থায় রয়েছেন। এ ছাড়া আদ্রা, উত্তর দক্ষিণ, জোড্ডা পূর্ব, পশ্চিম, দৌলখাঁড়, হেসাখাল, পেড়িয়া, মক্রবপুর ইউনিয়নের শতকরা ৮০ ভাগ গ্রাম বন্যাকবলিত অবস্থায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্যন্ত মাছ ধরতে গিয়ে বন্যায় পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে নাঙ্গলকোট পৌরসভার দাউদপুর গ্রামের কেরামত আলী (৪৫) নিহত হয়েছেন।
ভয়াবহ বন্যায় রোপা আমন, আউশ ধান, আমন বীজতলা ও শাকসবজির ক্ষেত ডুবে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানিতে কয়েক শ’ মাছের প্রজেক্ট ভেসে গিয়ে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে গেছে। মৎস্যচাষিদের চোখে-মুখে কান্নার রোল বিরাজ করছে।
গত বৃহস্পতিবার বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ছিল সর্বোচ্চ ভয়াবহ দিন। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বন্যাদুর্গত এলাকার বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে পানি ওঠায় কোমর সমান পানি ভেঙে মানুষজনকে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছাতে যুদ্ধ করতে হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে কেউ নৌকায় করে, আবার কেউ কোমর সমান পানি মাড়িয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছান। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও আশ্রয় নিতে দেখা যায়। উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, উপজেলা জামায়াতে ইসলামী, উপজেলা বিএনপি বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা ও রান্না করা খাবার বিতরণ করছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশ্রয়কেন্দ্রের মাঠে পানি ওঠায় বন্যাদুর্গতের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত নোয়াখালী বন্যাদুর্গতরা
নোয়াখালী অফিস জানায়, গত ১১ দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়া নোয়াখালীবাসী অন্তহীন সমস্যা জর্জরিত। চার দিন ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুতের সাড়ে ছয় লাখ গ্রাহক অন্ধকারে পড়ে গেছে। টিউবওয়েলগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় তীব্র বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দেয়।
জেলার আটটি উপজেলায় বন্যার পানিতে টিউবওয়েলগুলো ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দেয়। এতে মানুষের মধ্যে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিতে পারে। চার দিন ধরে নোয়াখালীর পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ থাকায় রাতের অন্ধকারে সাপের ভয়ে রাত কাটাচ্ছেন বন্যার্তরা পাশাপাশি বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল বন্ধ এবং নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখা দেয়। এতে দেশ-বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনদের যোগাযোগ করতে না পেরে উৎকণ্ঠায় রয়েছে তারা। দিনমজুর খেটেখাওয়া মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সরকারিভাবে যেহারে সাহায্য দিচ্ছে, তা চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল।

গত ১১ দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে পুরো নোয়াখালী। ভারী বর্ষণ ও ফেনী মুহুরীগঞ্জ নদীর পানি ধেয়ে আসায় বন্যার পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটেছে। বন্যার পানিতে বসতঘর, সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিমাণ পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। হাজার হাজর মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে। শত শত মৎস্যখামারের মাছ ভেসে গেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে আমন ধানের বীজতলা, শাকসবজি। বন্যা ও ভারী বর্ষণের কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এ দিকে দিনমজুর খেটেখাওয়া মানুষগুলো কাজ করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ দিকে দীর্ঘ ১১ দিন টানা ভারী বর্ষণের পর গতকাল শুক্রবার ভোররাত থেকে ভারী বর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। সূর্যের মুখ দেখা দেয়। এতে বন্যার মানুষগুলোর মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। এ দিকে রাস্তায় কোমর পরিমাণ পানি উঠে যাওয়ায় নৌকা দিয়ে মানুষ যাতায়াত করছে। প্রতিটি
নৌকা বিক্রি করছে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
রামগতির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকার মাছ
রামগতি (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা জানান, গত কয়েক দিনের অতিবর্ষণে ও মেঘনা নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারে রামগতি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ভেসে গেছে পুকুরে চাষ করা কোটি কোটি টাকার মাছ। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেক মৎস্যচাষি। অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে শত শত হেক্টর আমনের বীজতলা। বিভিন্ন বাড়িতে পানি উঠে বাড়ির আঙিনা ডুবে আছে হাঁটুপানিতে, অনেকের ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার হারুন বাজার, গুচ্ছগ্রাম, নয়া বাজার, আলী আকবর হাজিরহাট, তেগাছিয়া বাজার, চর আলগী, চর গাজী ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাগুলোতে বড় বড় গর্ত হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শাহে আলী রতন, আবুল খায়ের মাঝি জানান, জন্মের পর এত পানি দেখিনি। বিশেষ করে ইব্রাহিম মিয়ার সমাজে অবস্থিত মানুষগুলো বেশি আতঙ্কে রয়েছে।

আখাউড়ায় আবার ব্রিজ ধসে যোগাযোগ বন্ধ
আখাউড়া (ব্রাহ্মবায়িা) সংবাদদাতা জানান, গতকাল শুক্রবার আখাউড়ায় পানি কিছুটা কমলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। একটি সেতু ধসে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে মানুষ। আখাউড়ার সাথে কসবাসহ দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে।
সেতুর পাশে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটির মাটি সরে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে কয়েকটি এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

মিরসরাইয়ে পানিবন্দী লাখো মানুষ, নেই বিদ্যুৎ-মোবাইল নেটওয়ার্ক
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ছয় দিনের টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল ও ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে ওঠায় কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে হালদা নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর পানির তীব্রতা আরো বাড়ে। এখানে এখানো কার্যত পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। গতকাল শুক্রবার দুপুরের পর থেকে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে জোরারগঞ্জ, ইছাখালী, কাটাছরা, মিঠানালা ও মঘাদিয়া ইউনিয়ন। এর আগে গত তিন দিন ধরে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে করেরহাট, হিঙ্গুলী, ধুম ও ওচমানপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম।
এ দিকে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে বোট নিয়ে এসব এলাকায় উদ্ধারকাজ চালান বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা। তারা এ সময় শুকনো খাবারেরও ব্যবস্থা করে। ওইদিন রাতে করেরহাট, বারইয়ারহাট, শুক্রবার ইয়াহাট, বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল, মাদরাসা, ইউনিয়ন পরিষদ বভন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া মানুষকে খাবার সরবরাহ করতে দেখা গেছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে।

রাঙ্গুনিয়ায় বন্যার পানিতে ডুবে কিশোরের মৃত্যু
রাঙ্গুনিয়া-কাপ্তাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। তার নাম মোহাম্মদ রনি (১৭)। জানা যায় গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের ফুলবাগিচা গ্রামের জনৈক আবু বক্করের ছেলে রনিসহ কয়েকজন কিশোর বিকেলে বাঁশের ভেলা তৈরি করে গাবতল বাইস্যা ডেবার বিলে নামে। এ সময় বানের স্রোতে সবাই ভেসে যায়। এতে সাঁতার কেটে কূলে সবাই ফিরে এলেও রনি নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের প্রায় সাত ঘণ্টা পর একই দিন রাত সাড়ে সোয়া ১১টায় একই স্থানে তার লাশ পাওয়া যায়।

সিলেটে বিপদসীমার ওপরে কুশিয়ারা
সিলেট প্রতিনিধি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সিলেটে নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে এখনো জেলার কুশিয়ারা নদীর পানি তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত দুই দিন সিলেটের নদ-নদীর পানি বেড়েছে। শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত সিলেটের কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শেরপুর পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার শেওলাসহ ওই চার পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপরে ছিল। তবে শুক্রবার পানি কিছুটা কমেছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুরমা, কুশিয়ারা, লুভা, সারি, ডাউকি, সারি-গোয়াইন, ধলাইসহ জেলার সব ক’টি নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে শুক্রবার বেলা ৩টা পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা থেকে শূন্য দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে সহায়তা টিম পাঠালেন মঞ্জুর আলম
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, আলহাজ মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ও আলহাজ হোছনে আরা মনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ মোহাম্মদ মনজুর আলম ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলায় উদ্ধার টিম প্রেরণসহ চিকিৎসাসেবা, খাদ্যসামগ্রী ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। তিনি গতকাল সকালে ফেনী জেলায় ১০০ জনের একটি টিম প্রেরণ করেছেন। এই টিমে আছে উদ্ধারের জন্য পাঁচটি বোট, ১০ জনের চিকিৎসক টিম এবং তৈরি খাবার, শুকনো খাবার ও পানিসহ বিবিধ খাদ্যসামগ্রী রয়েছে। মানবিক কার্যক্রমের মধ্যে ছাগলনাইয়া উপজেলার মুহুরীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি বোট দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা সহায়তা, তৈরি খাবার, শুকনো খাবার ও সুপেয় পানি বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়াও অপর একটি টিম চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি এলাকার নাজিরহাট, শান্তিরহাট, ভুজপুর ও হাইদচকিয়াসহ বন্যাদুর্গত এলাকায় তিনটি বোট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তৈরি খাবার, শুকনো খাবার, পানিসহ নানাভাবে চলছে মানবিক তৎপরতা। স্মরণকালের এই মহাদুর্যোগে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবার প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। বিজ্ঞপ্তি।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪৯ লাখ মানুষ, মারা গেছেন ১৭ জন
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, আকস্মিক বন্যায় দেশের ১১টি জেলা আক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯। এসব জেলায় বন্যাকবলিত হয়ে মারা গেছেন ১৭ জন।
এ ছাড়া গতকাল রাঙ্গুনিয়া ও চকরিয়ায় আরো দুইজনের মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে গত রাত পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে।
জানা গেছে, আকস্মিক বন্যায় দেশের ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ৭৭টি উপজেলা এবং ৫৮৯টি ইউনিয়ন বা পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। এই ১১ জেলায় মোট ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৯ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। যাতে মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন।

এখন পর্যন্ত বন্যায় মৃত ১৭ জনের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে দু’জন নারী। আর জেলাভিত্তিক হিসাবে কুমিল্লায় চারজন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামের পাঁচজন, নোয়াখালীতে একজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন এবং কক্সবাজারের চারজন মারা গেছেন।
পানিবন্দী বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট তিন হাজার ১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট এক লাখ ৯৫ হাজার ৩০ জন লোক এবং ১৮ হাজার ৯৬টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
১১টি জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৩৯টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়গুলো থেকে তিন কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা ২০ হাজার ১৫০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।

চকরিয়ায় বন্যার পানিতে ডুবে ছাত্রের মৃত্যু
চকরিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা বরইতলী ইউনিয়নের বিবিরখীল গ্রামের মোহাম্মদ আবিদ (১৩) নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, বরইতলী ইউনিয়নের বিবিরখীল এলাকার ইজিবাইক, (টমটম) চালক জসিম উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আবিদ। বন্যার পানিবৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেছেন হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো: ফরিদ।

কুষ্টিয়ায় পদ্মা ও গড়াই নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, অতিবৃষ্টিতে কুষ্টিয়ার নদ-নদীর পানি মারাত্মভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তবে বিপদসীমার নিচে পানি থাকলেও আকস্মিক বন্যার আশঙ্কায় স্থানীয়রা দুশ্চিন্তায় রয়েছে। জেলার পদ্মা ও গড়াই নদীতে পানির তীব্রতা লক্ষ্য করা গেছে। প্রতি দিনই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তবে বিপদসীমার নিচে রয়েছে। এ দিকে পদ্মা এবং গড়াই কুলবর্তী এলাকা পানি নিমজ্জিত হয়েছে। জেলার দৌলতপুর উপজেলার চারটি ইউনিয়ন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নদীর চরাঞ্চলে থাকা হাজার হাজার একর জমির ফসল সম্পূর্ণ পানির নিচে। এলাকার নিচু এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পদ্মার চর এলাকার বসবাসকারীরা এরইমধ্যে এলাকা ছেড়ে নিরাপদে চলে আসতে শুরু করেছে।

রাজশাহীতে পদ্মার পানি বাড়ছে
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এ সময় পানি বেড়েছে ৪ সেন্টিমিটার। তবে এখনো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এনামুল হক এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে আবারো ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস
আগামী ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশেই বিক্ষিপ্তভাবে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বন্যাকবলিত ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারে গতকাল শুক্রবার বৃষ্টির প্রবণতা কম থাকলেও আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, আজ শনিবার থেকে এই এলাকাগুলোতে আবারো ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
গতকাল শুক্রবার সকালে দেয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, মৌসুমি বায়ু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর প্রভাবেই সারা দেশে বৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আগামী ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাস বলছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলসহ রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, বরিশাল ও সিলেটের অধিকাংশ জায়গায় দমকা হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement