বিশেষ আইন বাতিলসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে বড় সংস্কার দরকার
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১৯ আগস্ট ২০২৪, ০২:৫৬
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রথমে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বড় ধরনের সংস্কারে মনোনিবেশ করতে হবে। বৈষম্য দূরীকরণ এবং ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে এই সংস্কারের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বিশেষ আইন ২০১০ বাতিল করার দাবি জানিয়েছে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মেয়াজ্জেম বলেন, গত ১৪ বছরে দরপত্র ছাড়া বিভিন্ন চুক্তি করা হয়েছে এ আইনে। দুর্নীতির চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে বিভিন্ন নীতি। দেড় থেকে দুইগুণ বেশি চাহিদা হিসাব করে প্রক্ষেপণ তৈরি করা হয়েছে। এমন নীতি তৈরিই করা হয়েছে একটা গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে। নীতি ও আইন খাতে ১৭টি সংস্কার দরকার। তিনি বলেন, যেসব কোম্পানি বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির জন্য অযাচিতভাবে নির্বাচিত হয়েছে, তাদের সাথে লেটার অব ইনডেন্ট (এলওআই) বাতিল করতে হবে।
ধানমন্ডির সিপিডি নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংস্কার সিপিডির প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ আহ্বান জানান তিনি। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তি, গবেষণা সহযোগী মুশফিক আহসান হৃদয়, জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী আবু সালেহ শিবলী, অনুষ্ঠান সহযোগী জেবুননেচ্ছা।
ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী ২০৪১ সালে বিদ্যুতের চাহিদা হতে পারে ২৭ হাজার মেগাওয়াট। রিজার্ভ মার্জিনসহ ৩৫ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা ৫৮ হাজার মেগাওয়াট ধরা হয়েছে, যা অযৌক্তিক। এই অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি খাত এলএনজি, কয়লা আমদানির মতো অবকাঠামো তৈরির চাপ দিতে পারে। তাই এটার সংশোধন দরকার বলে আমরা মনে করছি। তিনি বলেন, দ্রুত বিদ্যুৎ ক্রয়ের বিশেষ আইন বাতিল করার পাশাপাশি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে জবাবদিহিতা বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাগিদ দিয়েছে সিপিডি।
তিনি জানান, উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার কারণে বিপিডিবিকে বছরে ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং বেসরকারি কোম্পানির কাছে বকেয়া বিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। সে সাথে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সাথে চুক্তির আওতায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে প্রতি বছর ৩৭ হাজার ৯৩ কোটি টাকার বাড়তি বোঝা টানতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
সিপিডির উপস্থাপনায় বলছে, প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতার অভাব ছিল। গত সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছানো অন্যতম। তবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে খরচের বোঝা কমত। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার দরকার। সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনটি ধাপে ছয় মাস, এক বছর ও তিন বছরের রূপরেখা তৈরি করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে শুরুতেই ১০০ দিনের একটি কর্মপরিকল্পনা হাজির করতে পারেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উপদেষ্টা। দ্রুত সংস্কারের বিষয়গুলো এ সময়ের মধ্যে রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া স্বাধীন কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ খাতে ভুতুড়ে বিল তদন্ত করতে হবে প্রথম ছয় মাসেই।
সিপিডি বলছে, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) ২০০৮ অনুসরণ করতে হবে। তবে এটি যাতে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ না হয়। দীর্ঘসূত্রতা কমানোর নামেই বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়েছিল এ খাতে। এটি শুরুর দিকে হয়তো দরকার ছিল। কিন্তু পরে বাতিল না করে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ আইন এখন বাতিল করে দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ড. মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪১ শতাংশ বেশি আছে। বর্তমানে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে, তা দিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করা যাবে। এর মধ্যে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আর নবায়ন না করা। এ সময়ে ২৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নবায়ন করা না হলে তিন হাজার ৬৫৫ মেগাওয়াট সক্ষমতা কমবে। এগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূরণ করা যেতে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যমান চুক্তি সংশোধন করে কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) বাতিল করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই শর্তে এটি করা যেতে পারে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও একই শর্তে চুক্তি করতে হবে। এতে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির চাপ কমে আসবে। বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কেন্দ্রভাড়া বাতিল করা দরকার।
সিপিডির দেয়া এ খাতের জন্য ১৭টি সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে। টেকসই জ্বালানি রূপান্তরে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারেও জোর দিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উত্তরণে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) সক্ষমতা বাড়াতে হবে। স্রেডাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অথবা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সাথে যুক্ত করা উচিত। সিপিডি বলছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)সহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গত কয়েক বছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করা জরুরি। কারণ এদের প্রতিবেদনে অনেক ঘাপলা রয়েছে। তবে এর দায়িত্ব দেশের কোনো অডিট ফার্মকে না দিয়ে আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মকে দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি হলে স্বচ্ছতা বজায় থাকবে বলে মনে করে সংস্থাটি। কুইক ইনহ্যান্সমেন্ট অব ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড পাওয়ার সাপ্লাই অ্যাক্ট, ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্লান (আইইএমপি), ন্যাশনাল এনার্জি পলিসি ও রিনিওয়েবল এনার্জি পলিসি সংস্কারের জোর দাবি জানায় সিপিডি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা