০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন

নজিরবিহীন বিক্ষোভে সঙ্কটে হাসিনা

-


চলতি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শাসনামলের সবচেয়ে ‘নজিরবিহীন’ বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছেন বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্ট।
সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। বিক্ষোভকারীরা গত সপ্তাহে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামী লীগের) গুণ্ডা বাহিনী ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং ঢাকার রাস্তার নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম (বিটিভি) হামলার শিকার হয়। দেশটির ৬৪টি জেলায় প্রায় অর্ধেক অঞ্চলজুড়ে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২০ জুলাই থেকে মাঠে নামে সশস্ত্র আর্মি। দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে কারফিউ জারি করে ক্ষমতাসীন দল। এর আগে দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা আওয়ামী লীগের প্রশাসন। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশের ১৭ কোটির বেশি মানুষ।
আন্দোলনকে দমাতে সব ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেয় বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ। গত কয়েক দিনে দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী এবং পথচারী নিহত হয়েছে । বাস্তবে সংখ্যাটা আরো বেশি। হাজারো মানুষ আহত হয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষ এই হত্যাকাণ্ডের হিসাব জানতে চায়, তবে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার ‘সঠিক হিসাব’ দেয়ার মানসিকতা নেই। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা হাসিনার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই বিক্ষোভ।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীনরা ৬১ হাজারের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছে। প্রধান বিরোধী দল (বিএনপি) দেশের অবস্থা অবনতির জন্য শেখ হাসিনাকে দায় দিচ্ছে। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখে আন্দোলনকারীদের উপর দমন-নিপীড়ন (ক্রাকডাউন) করার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে।

ছাত্র-সাধারণ মানুষ পথে নামলেও শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক স্বভাবসূলভভাবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আন্দোলনের পেছনের অপরাধী হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন (দলীয়) প্রশাসনের প্রতি। সঙ্কটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেশের অধিকাংশ মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাস্তবতায়, তিনি নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ‘সব কিছু’ করছেন।
বাস্তবতা হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উপকরণ বানিয়েছে। শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেই থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার মেয়ে।
বাংলাদেশের দুই পঞ্চমাংশ তরুণের কর্মসংস্থান নেই। তার মধ্যে দলীয় নেতা কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরিতে এনে এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রশাসনকে ধরে রাখছে আওয়ামী লীগ। প্রতি বছর চার লাখ স্নাতক চাকরি বাজারে প্রবেশ করে, যার বিপরীতে সরকারি পদের সংখ্যা মাত্র ৩০০০।

এবারের কোটাসংস্কার আন্দোলনের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে প্রাণহানির সংখ্যা কমতে পারত। গত ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। তবে কোটা পদ্ধতির চেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ অনেক বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে পুলিশ সদস্য, ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি থেকে প্রতিটি চাকরির সুযোগ আওয়ামী লীগের মাধ্যমে চলে।
দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজপথে আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্রলীগ একটি ‘খুনি সন্ত্রাসী’ বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। ক্যাম্পাসে এটি শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, এমনকি শিক্ষার্থীদের আবাসন রুম বিতরণও নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষমতার এ ধরনের অপব্যবহারকে ঘৃণা করে আসছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শেখ হাসিনা বিগত ১৫ বছরে দেশে বড় ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন, কিন্তু তিনি নির্বাচনে কারচুপি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার এবং আওয়ামী লীগের ব্যবসায়িক বন্ধু ও প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতির নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন।

বর্তমানে যারা শেখ হাসিনার শাসনকে সমালোচনা করে তাদের ‘রাজাকার’ হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষমতাসীনরা। ৭১ সালে পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগীরা রাজাকার নামে পরিচিত পেয়েছিল। এটি ইঙ্গিত করে যে ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী কতটা বাস্তবতাবর্জিত মূর্খ মন্তব্য করেছেন। এমনকি মিত্ররাও গোপনে স্বীকার করে যে হাসিনা ভুল করছেন। তারপরও কোনো মন্ত্রী তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না।
আন্দোলন দমনে একদিকে ক্ষমতাসীনদের অনুগামী পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাস, অন্য দিকে বিক্ষোভকারীদের পোড়ানো যানবাহনের দুর্গন্ধ তীব্র হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ হয়তো সম্ভবত ‘টিকে’ থাকবে। সহিংসতার রিপোর্ট বাড়বে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের একটি অঙ্ক তরুণ প্রজন্মকে দূরে রাখছে দেশের সেবা করা থেকে। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার জন্য সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি এবার বিপর্যয়কর হতে পারে।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement