০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ড্রোনের মতোই উড়ছিল মেধাবী তানভীন, বুলেট কেড়ে নিলো সব

-

এই অশ্রুমাখা সংবাদে থাকছে মাত্র ২৪ বছরে প্রাণ হারানো এক তরুণের গল্প। ড্রোনের মতোই মেধার জগতে উড়ছিল সে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসা পর্যন্ত ছিল তার মেধার দ্যুতি। ড্রোন বানাতো, বিক্রি করতো, আর তরুণদের ড্রোনের কলাকৌশল শেখাতো সে। কিন্তু এই তো সেদিন, গুলিতে ঝাঁজরা হলো ছেলেটির দেহ। নিষ্ঠুর গুলি মা-বাবার আদরের ছেলেকে তো কেড়ে নিয়েছেই, মেধার যে ফুলটি সৌরভ ছড়াচ্ছিল সেটিও নিভে গেল চিরতরে।
তরুণ এই মেধাবীর নাম জাহিদুজ্জামান তানভীন। তার অ্যাকাডেমিক প্রোফাইলটা ঠিক এমন- এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫, আইইউটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার শিক্ষাগত অর্জন বিস্ময়কর। প্রথম বর্ষে সে বুয়েটের নেভাল ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত প্রতিযোগিতায় জাহাজ চালানোর যন্ত্রের মডেল তৈরি করে পুরস্কার পায়। দ্বিতীয় বর্ষে বুয়েটের মেক্যানিকাল ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করে। বিদেশের নামকরা ইউনিভার্সিটি থেকে সে ড্রোন সিস্টেমের ওপর প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দু’টি দামি পুরস্কার অর্জন করে। আইইউটি (ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি) থেকেও ড্রোনবিষয়ক নানা পুরস্কার লাভ করে তানভীন। ড্রোন নিয়ে গবেষণাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। এর ওপরে সে ফ্রিতে নটর ডেম, সেন্ট জোশেফ, বিজ্ঞান ক্লাবে গিয়ে লেকচার দিত। প্রতি বছর নাসা আয়োজিত মঙ্গল গ্রহে চলার জন্য বিশেষযানের প্রতিযোগিতায় আইইউটির পক্ষে কোনো-না-কোনো পুরস্কার জিতে আনতো।
কিন্তু কী হয়েছিল তানভীনের? তানভীনরা থাকতো ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায়। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার ঘটনা। মায়ের জন্য কিছু টাকা উঠাতে বাইরে বেরিয়েছিল সে। সেই এলাকায় তখন হঠাৎ করেই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। চার দিকে গুলি চলতে থাকে মুহুর্মুহু। এ রকম একটি গুলি বুকে এসে বিদ্ধ হয় তানভীনের। গুলিবিদ্ধ তানভীনকে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে। হাসপাতালে নিলে কী হবে। তানভীনের নিশ্বাস আর ফিরে আসেনি। যে রক্ত ঝরেছে তার শরীর থেকে, তা যেন প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে তাকে চিরমুক্তি দিয়ে গেছে। তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়েছে।
জাহিদুজ্জামান তানভীনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের ভিটি-বিশাড়া গ্রামে। তার বাবা মো: শামসুজ্জামান ঢাকায় টোয়া করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মা বিলকিস জামান গৃহিণী। একমাত্র বোন জেসিকা জামান আয়েশা যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর করছেন।
আমার নিরীহ ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা : ‘আমার ছেলে অত্যন্ত বিনয়ী ও শান্ত ছিল। সে কোনো দিন আন্দোলনে যায়নি। আমার নিরীহ-নিরপরাধ ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা। সরকার কি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবে?’ বলছিলেন বিলকিস জামান।
একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান মা-বাবা। ছেলেকে দাফনের পর গত শুক্রবার নবীনগরের ভিটি-বিশাড়া গ্রামে ছিলেন তারা। মা বিলকিস জামানকে তখন শুধু বিলাপ করতে দেখা যায়। তিনি বলছিলেন, ‘আমাকে আত্মঘাতী বোমা এনে দেন। আমি মরে ছেলের কাছে চলে যাবো।’
বিলকিস জামান জানান, এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে জাহিদুজ্জামান বাসা থেকে বের হয়েছিল। দ্রুতই ফিরে আসবে বলে তাকে জানিয়েছিল। কিন্তু আধা ঘণ্টা পর এক শিক্ষার্থী ফোন করে জানান, তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পরে হাসপাতালে গিয়ে ছেলের লাশ দেখতে পান।
জাহিদুজ্জামানের স্নাতক শেষ হয়েছিল ২০২২ সালে। তিনি তিন বন্ধুকে নিয়ে ‘অ্যান্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তারা ড্রোন দিয়ে জরিপের কাজ করতেন। পাশাপাশি অনলাইনে ড্রোন বিক্রি করতেন।
জাহিদুজ্জামান এই প্রতিষ্ঠানকে আরো বড় করতে চেয়েছিলেন জানিয়ে বাবা মো: শামসুজ্জামান বলেন, ছেলের স্বপ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর করে আবার দেশে ফিরে আসবে। দেশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ছিল।
ছেলের সাথে বৃহস্পতিবার সকালে সর্বশেষ কথা হয় জানিয়ে শামসুজ্জামান বলেন, ফজরের নামাজ পড়তে ছেলেকে ডেকে তুলেছিলেন। সে উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তিনি অফিসে চলে যান। দুপুরে ফোনে জানতে পারেন, তার ছেলে মারা গেছে। এভাবে ওরা আমার ছেলেকে কেড়ে নিলো!


আরো সংবাদ



premium cement