০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

কোটা আন্দোলনকারীদের নামে ছাত্রলীগ ও পুলিশের ১১ মামলা

-

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীর শাহবাগ থানায় ১১টি মামলা দায়ের করেছে ছাত্রলীগ ও পুলিশ। এর মধ্যে ৯টি মামলার বাদি পুলিশ এবং দুইটি মামলার বাদি ছাত্রলীগের দুই নেতা।
শাহবাগ থানায় দায়ের করা একটি মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আকতার হোসেনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আকতার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ১৭ জুলাই গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার বিরুদ্ধে মামলাটি হয় ১৮ জুলাই।
১৭ জুলাই দুপুরে ক্যাম্পাসে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের কর্মসূচি ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। এই কর্মসূচিকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ মামলায় নাম উল্লেখ করা একমাত্র আসামি আকতার।
একই ধরনের কথা উল্লেখ রয়েছে আরো ৬টি মামলার এজাহারে। এই ৬টি মামলার মধ্যে ১৮ জুলাই হয়েছে ১টি, ২০ জুলাই ১টি, ১৯ জুলাই ২টি ও ২১ জুলাই হয়েছে ২টি। সব ক’টি মামলার বাদি পুলিশ। এসব মামলায় অজ্ঞাত আন্দোলনকারীদের আসামি করা হয়েছে।
এর আগে গত ১২ জুলাই শাহবাগ থানায় আরো একটি মামলা হয়। ওই মামলায় বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ১১ জুলাই পুলিশের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। সেদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে অজ্ঞাতনামা ছাত্ররা জড়ো হন। পরে বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে অজ্ঞাতনামা ছাত্ররা শাহবাগ মোড়ে গিয়ে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেন। পুলিশের সাথে তাদের ধাক্কাধাক্কি হয়। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের মারধর করা হয়।
এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, ১১ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাখা পুলিশের এপিসি-২৫ ও জলকামান গাড়িতে উঠে পড়েন কয়েকজন। তারা গাড়িতে ভাঙচুর চালান। তবে এই মামলাতেও আসামির তালিকায় কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।
ছাত্রলীগ নেতাদের দুই মামলা : অজ্ঞাতনামা ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ জন কোটা আন্দোলনকারীকে আসামি করে ১৭ জুলাই শাহবাগ থানায় মামলা করেন ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি।
এ মামলায় ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল দাবি করেন, কোটা সংস্কারের এক দফা দাবির আন্দোলনকে ঘিরে আন্দোলনকারীরা তাকে বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে আসছিলেন। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আন্দোলনকারীরা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের তার কক্ষে (২৩২ নম্বর কক্ষ) ১৫ জুলাই বিকেল ৪টায় প্রবেশ করেন। পরে কক্ষে থাকা তার মালামাল, সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দেন। এ ছাড়া অজ্ঞাত আন্দোলনকারীরা সেদিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করার জন্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলে প্রবেশ করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। পরে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ২০ থেকে ২৫টি কক্ষ ভাঙচুর করেন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা হলের ভেতর ভাঙচুর করে তাদের ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা আটক করে রাখেন বলেও এজাহারে অভিযোগ করেন।
রাজধানীর শাহবাগ থানায় ২১ জুলাই আরেকটি মামলা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মফিজুর রহমান। এজাহারে মফিজুর দাবি করেন, ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার জন্য যাত্রাবাড়ী থেকে রওনা দেন তিনি। যখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের ও প্লাস্টিক সার্জারি পূর্ব পাশে আসেন, তখন কোটা আন্দোলনকারীদের ব্যানারে থাকা ৫০ থেকে ৬০ জন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী তার মোবাইলফোন পরীক্ষা করেন। পরে তার মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। একপর্যায়ে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলে নিয়ে বিকেল থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়।
পুলিশের ৯ মামলা : কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ১৪ জুলাই গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতির বরাবর স্মারকলিপি দেন। কিন্তু পরদিন অজ্ঞাতনামা কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয় শাহবাগ থানায়। এ মামলার বাদি শাহবাগ থানার এসআই মো: সানারুল হক।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার জন্য ১৪ জুলাই সকাল ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজসহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীসহ বহিরাগত বেশ কিছু লোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন। পরে তারা মিছিল নিয়ে বিভিন্ন উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে প্রথমে শাহবাগ মোড়ে আসেন। এরপর তারা মৎস্য ভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টাকালে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পুলিশের বাধা অতিক্রম করে মৎস্য ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে আইইবি ভবনের সামনে বাধা দেয়া হয়।
এজাহারে বলা হয়, সেদিন ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি থাকায় সামনের দিকে যাওয়া যাবে না বলে আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পুলিশের অনুরোধ অমান্য করে সরকারি কাজে বাধা দেন। একপর্যায়ে কদম ফোয়ারা ক্রসিংয়ের সামনে পুলিশের সদস্যদের এলোপাতাড়ি মারপিট করেন এবং ইটপাটকেল ছুড়ে মারেন। এতে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন। এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, আন্দোলনকারীরা পুলিশের উদ্দেশে বিভিন্ন অশ্লীল কটূক্তি করতে থাকেন।
গায়েবানা জানাজা ও কফিনমিছিলকে ঘিরে মামলা : ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির বাসভবনের সামনে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচির পর কফিনমিছিল বের করেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। পরদিন ১৮ জুলাই শাহবাগ থানার এসআই মো: সানারুল হক বাদি হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য পূর্বঘোষিত গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি ছিল ১৭ জুলাই। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীকে হল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা হল ছেড়ে না দিয়ে দেশে অস্থিরতা ও অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আন্দোলন করবেন বলে জানান। গায়েবানা জানাজা শেষ করে একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল নিয়ে মিছিল শুরু করেন। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ভবনের সামনের সড়কে বিভিন্ন প্রকার উসকানিমূলক স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের রাস্তা ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পুলিশ সদস্যদের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন বলে এজাহারে অভিযোগ করেছে পুলিশ। এতে আরো বলা হয়, আন্দোলনকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের মাথার হেলমেট ভেঙে যায়। কয়েকজন আহত হন।
আরেকটি মামলার এজাহারে শাহবাগ থানার এসআই মাইনুল ইসলাম খান উল্লেখ করেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ করেন। অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করার প্রতিবাদে বেলা ৩টায় ছাত্রলীগ তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি শুরু করে। ছাত্রলীগের অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে বিকেল ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে প্রবেশ করে ভাঙচুর শুরু করেন। পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা অন্যান্য হলেও প্রবেশ করে ভাঙচুর করেন। তারা ছাত্রলীগসহ সাধারণ ছাত্রদের হলে প্রবেশে বাধা দেন। ছাত্রলীগ ও সাধারণ ছাত্ররা হলে প্রবেশ করতে গেলে তাদের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। পাশাপাশি ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করেন। এতে ২৫০ থেকে ৩০০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালনের সময় আন্দোলনকারীরা পুলিশের উদ্দেশে ককটেল ছুড়ে মারেন।


আরো সংবাদ



premium cement