১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩০, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ক্র্যাকডাউন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে

নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ
-


যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশে চলমান কোটা আন্দোলন ও এটিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা নিয়ে এক বিশ্লেষণে বলেছে, এবারের বিক্ষোভে কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসার পর এটি এখন পর্যন্ত তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
গত ২৩ জুলাই, ২০২৪ প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, যারা বাইরে থেকে দেখছেন, তাদের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি আকর্ষণীয় গল্প উপস্থাপন করেছেন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন মহিলা সরকারপ্রধানদের মধ্যে একজন, আর রঙিন শাড়ি পরা এমন একজন ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম যিনি ইসলামিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন এবং ভারত ও চীন উভয়কেই তার পাশে রেখেছেন।
কিন্তু এই আপাতদৃষ্টিতে সাফল্য এসেছে একটি ভারী মূল্য দিয়ে। বিগত ১৫ বছরে, শেখ হাসিনা তার কর্তৃত্বকে গভীরভাবে সংহত করেছেন এবং ১৭ কোটি মানুষের এই জাতিকে বিভক্ত করেছেন। যারা তার ক্ষমতার রিংকে চুম্বন করেছিল তাদের পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতা এবং দায়মুক্তি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। আর যারা ভিন্নমতাবলম্বী তাদের ভাগ্যে জোটে দমন-পীড়ন, সীমাহীন আইনি ঝামেলা ও কারাবরণ।
পত্রিকাটির বিশ্লেষণে বলা হয়, এই মাসে যে টেকসই প্রতিবাদ বাংলাদেশকে আন্দোলিত করেছে তা হলো নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জন্য হাসিনার ফর্মুলার বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া। এটি এমন এক রক্তাক্ত ক্র্যাকডাউন, যাতে কমপক্ষে ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছে, যা টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাস পরে তার আধিপত্যের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে ।
বিশ্লেষণে বলা হয়, সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী এবং শেখ হাসিনার দলের ক্যাডারদের কর্মকাণ্ডের সহিংস প্রতিক্রিয়া দেশকে নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। এরপর কারফিউ জারি করা হয়। সামরিক বাহিনী রাস্তায় টহল দেয়, হেলিকপ্টার প্রায়ই উপরে চক্কর দেয়। ইন্টারনেট বন্ধ করা হয় এবং ফোন কল গুরুতরভাবে সীমিত করা হয়।

এই ক্র্যাকডাউনকে কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা এমন নৃশংসতা বলে অভিহিত করেছেন যা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশে নজিরবিহীন ছিল। কূটনীতিক ও কর্মকর্তারা বলছেন যে, কমপক্ষে ১৫০ জন নিহতের সংখ্যা একটি রক্ষণশীল। স্থানীয় সংবাদপত্র মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে ২০০-এর কাছাকাছি, আর ছাত্র বিক্ষোভের নেতারা বলছেন যে সংখ্যা সম্ভবত তার কয়েকগুণ।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিসেস হাসিনা তার সেবায় প্রতিটি বাহিনীকে রাস্তায় মোতায়েন করেছেন, যার মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর আধাসামরিক ইউনিট রয়েছে যাদের নেতারা অতীতে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে।
একজন সিনিয়র কূটনীতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়, বিক্ষোভের নৃশংস প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে একদল বিদেশী রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ছাত্র বিক্ষোভকারীদের উপর দমন-পীড়নে হেলিকপ্টার এবং জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষীদের গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে।

পরিষেবা সঙ্কটের কথা উল্লেখ করে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাশীল এই সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, কারফিউতে পণ্য পরিবহনে বাধা সৃষ্টির ফলে মঙ্গলবার, রাজধানী শহর, ঢাকা, গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহের অভাব ছিল। কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, বিশেষ করে সবজির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধের ফলে প্রিপেইড মিটার পুনরায় লোড করতে না পেরে লোকেরা বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিসের বাইরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিল।
পত্রিকাটি উল্লেখ করে যে, সরকার বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করার উদ্দেশ্যে যোগাযোগ ব্ল্যাকআউট করা হয়েছে বলে দাবি করলেও এটি নিহতের সংখ্যাকে আড়াল করেছে বলে মনে করা হয়। সেলফোন ফুটেজে দেখা যায় যে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছেন, অথবা রাস্তার ওপর নির্বিকারভাবে লাশ ফেলে দিচ্ছেন।

বিশ্লেষণ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, জনাকীর্ণ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকরা বর্বরতার ব্যাপক প্রমাণ দেখতে পান। চোখে পেলেট গান বা রাবার বুলেটের আঘাত নিয়ে অন্তত ৩৯ জনকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধেক এক বা উভয় চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা দেশের ক্যারিশম্যাটিক প্রতিষ্ঠাতা নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, যিনি ১৯৭৫ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যসহ নিহত হন। ২৮ বছর বয়সী মিসেস হাসিনা ও তার এক বোন তখন বিদেশে ছিলেন এবং গণহত্যা থেকে বেঁচে যান। তার ট্রমা তার রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। তিনি তার অনুসারীদের স্বাধীনতার উত্তরাধিকারের উপর একচেটিয়া অধিকার প্রদান করতে সহায়তা করেছেন। ভিন্নমত পোষণকারীদের এখনও বিশ্বাসঘাতকতা ও চরমপন্থার পুরনো শক্তির সম্প্রসারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য অভিযুক্ত করা হলে তখন তিনি এই বলে উত্তর দেন যে তারা ক্ষমতায় থাকার সময় আরও খারাপ পন্থা অবলম্বন করেছিল।
এতে বলা হয়, বিরোধী দলগুলো অগত্যা সাম্প্রতিক বিক্ষোভের প্ররোচনাকারী ছিল না, কিন্তু তারা এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যা বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা বাড়িয়েছে। মিসেস হাসিনার ক্র্যাকডাউন তাদের উন্মুক্ত করে দিয়েছে যখন তিনি তাদের আইনি পদক্ষেপে আটকে ছিলেন এবং ভয় দেখিয়ে তাদের চুপ করে দিয়েছিলেন।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, এই অভ্যুত্থানটি মিস হাসিনার জন্য দুইভাবে বিপজ্জনক প্রমাণিত হতে পারে: এটি ব্যাপক অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে আসতে পারে আর তার পাশাপাশি তার বাড়াবাড়ির দিকে সবার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প ইতোমধ্যেই উন্মোচিত হয়ে গেছে। পোশাক রফতানির উপর দেশের নির্ভরতা তার প্রান্তঃসীমায় পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে এবং সরকার প্রবৃদ্ধির বিকল্প উৎস খুঁজে পেতে লড়াই করেছে। মহামারী এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের ব্যাঘাতগুলোও অর্থনীতিতে আঘাত এনেছিল, যার ফলে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেড়ে যায় এবং বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যায়।
অর্থনৈতিক উদ্বেগের এই পরিবেশে, সরকারি চাকরিগুলো ছিল লোভনীয় স্থিতিশীল বিকল্প। এর মধ্যেই তরুণদের মধ্যে এমন একটি অনুভূতি ছিল যে সেই চাকরির পথটি প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কারচুপির মাধ্যমে বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি তাদের রাস্তায় নামিয়েছে তা হলো যে এই চাকরির অর্ধেক কোটা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্তদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক সময় ধরেই এই কোটা চালু ছিল। ১৯৭০-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের সবচেয়ে বড় অংশ রাখা হয়েছে শেখ হাসিনা তার নিজের সমর্থকদের বোঝাতে নতুনভাবে এর সংজ্ঞায়িত করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভ মিস হাসিনাকে ২০১৮ সালে সিস্টেমটি বাতিল করতে এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে এটিকে প্রতিস্থাপন করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মিস হাসিনার প্রতি অনুগত হিসাবে দেখা আদালত গত এই গ্রীষ্মে পুরনো ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করেছে। ছাত্ররা যখন এর প্রতিবাদ শুরু করে, তখন তিনি তাদের ‘রাজাকার’ এর বংশধর হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। এটি এমন একটি শব্দ যা মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। এটি বিক্ষোভকারীদের ক্ষুব্ধ করে এবং মিস হাসিনার সমর্থকদের তাদের আক্রমণ করার জন্য একটি ইঙ্গিত হিসাবে কাজ করে। এরপর জাতীয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে, নতুন পাতাল রেললাইনে এবং পুলিশের গাড়িতে ভিড়ের আক্রমণসহ সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, মিস হাসিনার মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা বলেছেন যে রাষ্ট্র শুধু অবকাঠামো রক্ষা এবং আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য কাজ করেছে এবং তারা মৃত্যুর তদন্তের প্রতিশ্রতি দিয়েছে। রোববার, দেশটির সুপ্রিম কোর্ট যুদ্ধের প্রবীণদের জন্য সংরক্ষিত সরকারি চাকরির সংখ্যা কমিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদিও মিস হাসিনার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ভর করতে পারে সামরিক বাহিনী তার পক্ষে দৃঢভাবে থাকবে কি না বা অতীতের মতো তার বাজি রক্ষা করবে কি না তার ওপর।
পত্রিকাটিতে বলা হয় যে, বিক্ষোভকারীরা মুহূর্তের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও তাদের দাবি পূরণ না হলে পুনরায় একত্র হওয়ার কথা বলেছে। কিছু মহল বলছে, আন্দোলন এখন আর কোটা নিয়ে নয় আন্দোলন হবে নিহতদের বিচারের জন্য। একটি দল ৯ দফা দাবির তালিকা দিয়েছে, যার মধ্যে মিসেস হাসিনার ক্ষমা চাওয়া এবং তার কিছু সহযোগীর পদত্যাগও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement
কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ঘটবে : নোবিপ্রবি ভিসি রূপালি গিটারের জাদুকরের মৃত্যুর ৬ বছর শৈলকুপায় পানিতে ডুবে শিক্ষার্থীর মৃত্যু দ. আফ্রিকা টেস্টে সাকিবের পরিবর্তে হাসান মুরাদ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়ে ইসরাইলকে রাশিয়ার সতর্কবার্তা ফতুল্লায় যুবককে কুপিয়ে হত্যা বদলে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে ডাইনোসর অবলুপ্তির তত্ত্ব! উত্তাল বঙ্গোপসাগর, ভোগান্তিতে কুয়াকাটা ব্যবসায়ীরা ধামরাইয়ে মাইক্রোবাসে গ্যাস রিফিলের সময় বিস্ফোরণ, চালক নিহত ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী নাদিম হত্যা মামলায় তাঁতী লীগের নেতা গ্রেফতার কিম সৈন্যদের বলেছেন দক্ষিণ শত্রু, বিদেশী দেশ

সকল