০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২ মহররম ১৪৪৬
`

নিজভূমে পরবাসী ব্রাহমা

-

অল্প সময়ে বিশালদেহী গরু। ভালো জাত হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ১৯২৫ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত এটি সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর জাত উন্নয়নের মাধ্যমে আমেরিকান ব্রাহমা ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন নাম দেয় ব্রাহ্মণ বা ব্রাহমা। মাত্র দুই বছরেই হাজার কেজিরও বেশি গোশত উৎপাদনে সক্ষম এই জাতের গরু। তাই বিশ্বজুড়ে এই গরুর বেশ সমাদর আছে। বিশেষ করে গোশতের জন্য। তবে এই উপমহাদেশে যার আদিবাস, সেই গরু এখন নিষিদ্ধের তকমা। সম্প্রতি বংশ মর্যাদাপূর্ণ কোটি টাকার গরুকে ঘিরে আলোচনার ডালপালা ছড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ব্রাহমা জাতের গরু লালন পালন ও আমদানিকে নিষিদ্ধ বলা হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এ নিয়ে দেশজুড়ে খামারিদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা বিভ্রান্তি। অথচ নিষিদ্ধ তো দূরের কথা বরং অধিক গোশত উৎপাদনের লক্ষ্যে এই জাতকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের সুপারিশ করেছিল সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। দেশের কোনো আইনেই ব্রাহমাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। উল্টো সরকারের প্রকল্প থেকে ব্রাহমার সিমেন পেয়ে সারা দেশে খামারিরা লালন পালন করছেন এই জাতের গরু।

দেশে ব্রাহমার লালন-পালন ও বাজারজাতকরণ নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, আমাদের বেসরকারি পর্যায়ে গবাদিপশু কৃত্রিম প্রজনন সংক্রান্ত একটি নীতিমালা আছে। সেখানে বলা আছে, ব্রাহমা জাতের গরুকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, কিন্তু নিষিদ্ধ নয়। ব্রাহমা জাতের গরুগুলো আমাদের দেশি বা উন্নত জাতের গরুর সাথে ক্রস হয়ে গেলে মারাত্মকভাবে দুধ উৎপাদন কমে যাবে। যেটা আমাদের দেশিজাত ও দুধ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সেজন্য আমরা এটা নিরুৎসাহিত করছি। আমরা যদি কোনো কারণে ব্রাহমা জাতের গরুকে আমদানি করার কোনো সুযোগ দেই তাহলে আমাদের অজান্তেই ক্রস হয়ে যেতে পারে। তাহলে এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। সে কারণে যে বিপর্যয় ঘটবে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা আমাদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। এ বিপর্যয় এড়ানোর জন্য এটা আমরা নিরুৎসাহিত করছি।

২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্রাহমা গরু পালনে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর কয়েক দফায় শত কোটি টাকা খরচ করে। প্রথমে বিফ ক্যাটেল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে ১১ উপজেলায় তিন বছরের জন্য পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয়। পরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ৬০ হাজার শুক্রাণু এনে দেশী গাভীতে ঘটানো হয় প্রজনন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৮ জেলার ১৮৫ উপজেলায় ব্রাহমার বিস্তার ঘটানো হয়। এ ধারাবাহিকতায় এখনো খামারিরা ব্রাহমা জাতের গরু পালন করছেন। তবে দুধ উৎপাদন কমার অজুহাত তুলে ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়। বেসরকারি পর্যায়ে কৃত্রিম প্রজননের সাথে জড়িত সংস্থাগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন ও পরামর্শ দেয়ার কাজ করে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রেগুলেটরি কমিটি (এনটিআরসি)। সংস্থাটি নির্বাচিত কিছু এলাকায় ব্রাহমা জাতের গরুর উৎপাদনের পক্ষে। তবে তাতেও রহস্যজনক কারণে সায় নেই প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের।

কিন্তু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিফ ক্যাটেল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের সমাপ্তির ওপর ২০১৮ নভেম্বরে মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে ব্রাহমা জাতের মাংসাল গরু পালনে খামারিদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং এই খাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ফলে আত্ম কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকার সমস্যার সমাধান সহজতর হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক ডা: মো: আইনুল হক প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্রাহমা জাতের গরুর লালন-পালন কতটা বা কেন দরকার এই প্রসঙ্গে লেখেন, ‘বাংলাদেশে ইতোপূর্বে একটি টেকসই, লাভজনক এবং অধিক মাংস উৎপাদনকারী গরুর কোন জাত না থাকায় চাহিদার তুলনায় প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন অত্যন্ত কম ছিল। ইতোমধ্যে দেশ মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এখন প্রয়োজন এর ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখা। একটি দেশীয় গরুর প্রাপ্ত বয়সে মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে মাত্র ৭০-৮০ কেজি, সেখানে ব্রাহমা জাতের একটি প্রাপ্ত বয়স্ক (২০-২৪ মাস) গরুর মাংস উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ৮০০-১০০০ কেজি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি। তাই মাঠপর্যায়ের কৃষক-খামারিদের মধ্যে ব্রাহমা জাতের গবাদিপশু পালনে আগ্রহ ও উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়েছে। এই প্রকল্পটি পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে ২-৩ বছর বয়সের একটি গরুর ওজন প্রায় ২৭ মণ বা ১ মেট্রিক টন পর্যন্ত হতে পারে। সঠিক মাত্রায় খাদ্য দিলে বাংলাদেশে একটি ব্রাহমা জাতের বাছুরের দৈনিক গড়ে ৯০০-১০০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন বাড়ে।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ ইমরান বলেন, দেশের কোনো আইন ও নীতিমালায় ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি নিষিদ্ধ নয়, তবে এটা নিয়ন্ত্রিত। ব্রাহমা লালন-পালন, সিমেন আমদানি ও বিধি মেনে ব্যবহারেও বাধা দেয়া হয়নি। তবে কেন যেন এই জাতের গরু লালন-পালন ও সম্প্রসারণে বাধা দেয়া হয়। আসলে মূল সমস্যা হলো নিয়ন্ত্রিত ও নিষিদ্ধ নিয়ে এ দুইটা শব্দের মধ্য পার্থক্য আছে সেটা অনেকেই বুঝি না। যখন সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এটাকে নিষিদ্ধ বলবে তখন মানুষের মনে হবে এটা অবৈধ কিছু। আসলে ব্রাহমা গরু নিষিদ্ধ নয়, নিয়ন্ত্রিত।

তিনি বলেন, গোশতের দাম কমানোর জন্য এ গরুর কোনো বিকল্প নেই। এ জাতটির আদি নিবাস যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশ, ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এটি বেশ উপযোগী। এমনকি ফ্রিজিয়ান জাতের গরু পালতে যেখানে তুলনামূলক ঠাণ্ডা আবহাওয়া তৈরিতে খামারিকে ফ্যান-এসি চালাতে হয়, সেখানে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও স্বাভাবিক থাকে ব্রাহমা জাতের গরু।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো আইনেই ব্রাহমা গরু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। তবে আমদানিতে কঠোরতা আছে। নিষিদ্ধ না হলে কেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এ জাতকে- এর জবাবে ডা: রেয়াজুল বলেন, দেশী গাভীতে ব্রাহমার শুক্রাণু দিয়ে প্রজনন ঘটানো হলে যেসব ফিমেইল ক্যাটল জন্ম নেয়, সেগুলো থেকে কোনো দুধ পাওয়া যায় না। এখানেই দুধের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে সরকার প্রকল্প থেকে এ সরে আসে। আমাদের পক্ষ থেকে দুধও দেবে, মাংসও দেবে এমন জাতের গরু চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ডা: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খামারিকে স্বপ্ন দেখিয়ে কার স্বার্থে আবার প্রকল্প বন্ধ করা হলো, সেটিও খোঁজা দরকার। প্রকল্পের অধীনে ছড়িয়ে পড়া ব্রাহমা গরুর ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। এই দেশে কৃষি নিয়ে কম ষড়যন্ত্র হয়নি। এবারো হয়তো প্রাণিসম্পদ খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। সরকারের উচিত তদন্ত করে এসব বের করা। সব মিলিয়ে প্রাণিসম্পদ খাতে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তা ঠেকানো না গেলে কয়েক বছরের মধ্যেই বিপর্যয় নামতে পারে। এতে কমতে পারে সার্বিক মাংস উৎপাদন।


আরো সংবাদ



premium cement