হঠাৎ চাঙ্গা দুদক
- জিলানী মিলটন
- ০৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০, আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৬:২১
পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরুর মধ্য দিয়ে নীরবে থাকা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হঠাৎ আলোচনায় এসেছে। বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শেষ হতে না হতেই দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে কোরবানির ঈদে এক ছাগলকাণ্ড নিয়ে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বেশ কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বিপুল অবৈধ সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুদক।
কোরবানির ঈদে ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান দম্পতির বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। একইভাবে এনবিআরের আরেক কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইতোমধ্যে ১৬ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৯০৮ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়াও তার আরো সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকের তিন সদস্যদের অনুসন্ধান টিম মাঠে কাজ করছে।
ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান দম্পতির সম্পদের তথ্য চেয়ে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৩০ জুন দুদকের উপপরিচালক আনোয়ার হোসেনের স্বাক্ষরে এসব চিঠি পাঠানো হয়েছে। একইসাথে মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক সংশ্লিষ্টরা জানান, কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেশের কোথাও কোনো স্থাবর সম্পদ আছে কি না, সেটি যাচাই করা শুরু করা হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মো: আনোয়ার হোসেনের স্বাক্ষরিত চিঠি দেশের বিভিন্ন জেলার সাব-রেজিস্ট্রারদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইতোমধ্যে তাদের আবেদনের পর আদালত মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। লায়লা কানিজ সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসে উপজেলা পরিষদের বৈঠক করেছেন। অন্য দিকে মতিউর রহমানও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সশরীরে যোগ দিয়ে অফিস করেছেন। তবে নিয়মিত অফিস করেন কি না সেটি তিনি নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও মতিউর দেশে আছেন বলেই তিনি মনে করেন।
অন্য দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) ও অতিরিক্ত কর কমিশনার কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালকে ৩০ জুন বদলি করে বগুড়ায় পাঠানো হয়েছে। তাকে বগুড়া কর অঞ্চলের পরিদর্শী রেঞ্জ-১-এ বদলি করা হয়। তার দুর্নীতি অনুসন্ধানে এরই মধ্যে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে দুদক। এনবিআর কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানকালে এখন পর্যন্ত নামে-বেনামে ১৬ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৯০৮ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে বলে দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। গত ২৭ জুন দুদকের আবেদনের পর আদালত এসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে ফয়সালের যত স্থাবর সম্পদ : রাজধানীর উত্তর মেরাদিয়া মৌজায় শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের প্লট কিনেছেন কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। শ্বশুর আহম্মেদ আলীর নামে রাজধানীর রমনা থানা এলাকায় সিদ্ধেশ্বরী রোডে ‘রূপায়ণ স্বপ্ন নিলয়’ নামে বিল্ডিংয়ের ১০ তলায় আই-১০ নম্বরের দুই হাজার ৯৯০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট এবং ২৩৮ বর্গফুট আয়তনের কার পার্কিংয়ের জায়গা কিনেছেন। ওই ফ্ল্যাট কেনা বাবদ আবু মাহমুদ ফয়সালের হিসাব থেকে এক কোটি টাকা পরিশোধের তথ্য পেয়েছে দুদক।
ফয়সালের স্ত্রী আফসানা জেসমিনের নামে বড় কাঁঠালদিয়া মৌজায় ৫ কাঠার প্লট কেনা হয়। সেখানে ফয়সালের অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়া হয় ৭৫ লাখ টাকা। নিজের ও স্ত্রী আফসানা জেসমিনের যৌথ মালিকানায় বড় কাঁঠালদিয়া মৌজায় আরো একটি ৫ কাঠার প্লট ক্রয় কেনেন তিনি, যার দলিল মূল্য ৩৪ লাখ সাত হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
আফসানা জেসমিনের নামে রূপগঞ্জ উপজেলার কামতা মৌজায় পূর্বাচল নতুন শহর আবাসিক প্রকল্পে ২০০ দশমিক ১৭ বর্গমিটার আয়তনের প্লট কেনেন ফয়সাল, যার দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে সাত লাখ ৪২ হাজার টাকা।
কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে রূপগঞ্জ উপজেলার কামতা মৌজায় ৬ কাঠার ১/৭ অংশ প্লট দুই লাখ টাকায় কেনা হয়েছে বলে দলিলে উল্লেখ করা হয়। নিজ নামে রূপগঞ্জ উপজেলার গুতিয়াব মৌজায় দশমিক শূন্য ৩ একর প্লট সাত লাখ ১০ হাজার টাকায় কিনেছেন। কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে রূপগঞ্জ উপজেলার হারারবাড়ি মৌজায় ৩৩৪ দশমিক ৪৫ বর্গমিটার প্লট ১২ লাখ ১৬ হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন। নিজ নামে খিলগাঁওয়ের নন্দিপাড়া মৌজায় শূন্য দশমিক ২৭ একরের শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ জমি দুই লাখ টাকায় কিনেছেন।
সব মিলিয়ে আবু মাহমুদ ফয়সালের নিজ নামে, স্ত্রী আফসানা জেসমিন, শ্বশুর আহম্মেদ আলী ও শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে সর্বমোট ছয় কোটি ৮৯ লাখ ৭৫ হাজার মূল্যের স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক।
অস্থাবর সম্পদ : কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় মোট দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানে ৮৭ ব্যাংক হিসাবে মোট ছয় কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার ৯০৮ টাকা স্থিতির তথ্য পাওয়া গেছে। আবু মাহমুদ ফয়সাল ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে সর্বমোট ৯ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার ৯০৮ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়।
সব মিলিয়ে তাদের নামে রোববার (৩০ জুন) পর্যন্ত ১৬ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৯০৮ টাকার বেশি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক।
সাবেক আইজিপি বেনজীর : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসার পর থেকে তাকে নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে। দুর্নীতির জন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। বেনজীর আহমেদ এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ৬২১ বিঘা জমি, ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পেয়েছে দুদক। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
এ ছাড়া বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের দুই দফায় তলব করে দুদক। তবে তারা আইনজীবীর মাধ্যমে দুদকে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। বুধবার দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন সাংবাদিকদের জানান, বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রথ্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় র্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন। যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ।
কাস্টমস কমিশনার এনামুলের ৯ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ : সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হকের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলায় আট কোটি ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ টাকার জমি ও ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত দুদকের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক ফারজানা ইয়াসমিন এই আবেদন করেন।
ক্রোককৃত সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর গুলশানের জোয়ার সাহারায় ৬১ লাখ টাকার তিন কাঠা জমি, খিলক্ষেত্রে ৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকার ৩৩ শতাংশ জমি, কাকরাইলের আইরিশ নূরজাহানে কমন স্পেসসহ ১১৭০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, যার মূল্য ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা, একই ভবনে কারপার্কি স্পেসহ ১৮৩৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। এর মূল্য ৫১ লাখ ২৯০০ হাজার টাকা।
এছাড়া কাকরাইলে ১৯০০ বর্গফুট ও ৩৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ কারপার্কিং রয়েছে যার মূল্য দুই কোটি আট লাখ ৫০ হাজার টাকা। গাজীপুরে ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকার পাঁচ কাঠা জমি। মোহাম্মদপুরে তিনটি বাণিজ্যিক ভবনে চার হাজার বর্গফুটের তিনটি স্পেস। যার প্রতিটির মূল্য ৭১ লাখ ৩৫ হাজার করে। মোহাম্মদপুরে ১০ হাজার ৯৬৫ বর্গফুটের স্পেস রয়েছে যার মূল্য দুই কোটি ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ ছাড়া গুলশানের ৭২ লাখ টাকার ২৪২৮ বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং বাড্ডায় চার কাঠা নাল জমি, যার মূল্য ১৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা