০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ৩০ জিলহজ ১৪৪৫
`

কোটা নিয়ে উত্তাল শিক্ষাঙ্গন

রাজধানীর শাহবাগে কোটাবিরোধীদের সড়ক অবরোধ। রাজশাহীতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ (ইনসেটে) : নয়া দিগন্ত -

- ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে শাহবাগে বিক্ষোভ
- মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায় আপাতত বহাল
- হাইকোর্টের রায় স্থগিত না হওয়ায় ক্ষোভ শিক্ষার্থীদের

সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চতুর্থ দিনে গতকাল উত্তাল ছিল সারাদেশ। কোথাও ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেননি শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, কুমিল্লা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন।
এর মধ্যে কোটা নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি গতকাল মুলতবি হয়েছে। রিট আবেদনকারীপক্ষের সময়ের আরজির পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ‘নট টুডে’ (আজ নয়) বলে আদেশ দিয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের এমন আদেশে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরো বেড়েছে। তাদের দাবি, কোটা বাতিল মীমাংসিত ইস্যু। নতুন করে কোটা ফিরিয়ে আনা ছাত্রসমাজের সাথে তামাশা। কোনোভাবেই বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি মেনে নেয়া হবে না। এ দিকে শাহবাগে প্রায় ৪ ঘণ্টার অবরোধের কারণে গতকাল পুরো রাজধানীতে তীব্র যানজট দেখা দেয়।
ঢাবি প্রতিনিধি জানান, গতকাল হাইকোর্ট কর্তৃক ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহালে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের বাধা অতিক্রম করে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও টানা চতুর্থ দিনের মতো রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
প্রথমে গতকাল সকালে শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা। পরে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা এসে আন্দোলনে যোগ দেন। শুরুতে ঢাবি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে একত্র হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলটি অপরাজেয় বাংলা, টিএসসি, কেন্দ্রীয় মসজিদ ও শাহবাগ মোড়ে এসে শেষ হয়। এরপর তারা বিক্ষোভ শুরু করেন। ৬ ঘণ্টাব্যাপী শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন। এতে, শাহবাগের আশেপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যদিও এম্বুলেন্সে যাওয়ার জন্য নির্বিঘেœ জায়গা করে দেন তারা।
বিক্ষোভ সমাবেশে ‘কোটা না মেধা,’ ‘কোটা প্রথার বিলুপ্তি চাই;’ ‘হাইকোর্ট না রাজপথ,’ ‘সারা বাংলায় খবর দে,’ কোটা প্রথার কবর দে বলে স্লেøাগান দেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে, আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যোগ দিতে গেলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বাধা দেন। বিভিন্ন হল গেটে তালা দেয়াসহ হল গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল শাখার নেতাকর্মীরা। তবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সব বাধা উপেক্ষা করে তাদের সামনে দিয়েই হল গেট দিয়ে বেরিয়ে কোটা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এ মর্মে নাম প্রকাশ না করা শর্তে সূর্যসেন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদেরকে ছাত্রলীগের নেতারা হলে আটকে রেখেছিল, যাতে আমরা কোটা আন্দোলনে না যেতে পারি। তারা নেতাদের খুশি করার জন্য আমাদের সাথে এমনটা করেছে। তবে সব বাধা অতিক্রম করে আমরা আন্দোলনে এসেছি। দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।
বিক্ষোভ সমাবেশে আজ শুক্রবার সারাদেশে কোটা বাতিলের পক্ষে অনলাইনে ও অফলাইনে জনসংযোগ ও সমন্বয় মিটিং করবে কোটা বিরোধীরা। আগামীকাল শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও রোববার সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন তারা। শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নাহিদ ইসলাম এ ঘোষণা দেন।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
রাবি প্রতিনিধি জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা হাইকোর্ট কর্তৃক পুনর্বহালের আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একই সাথে তারা ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে গতকাল তারা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে বিক্ষোভ করেছেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন সংলগ্ন প্যারিস রোডে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে সমবেত হতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের।
এ সময় তারা স্লোগান দেন- ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাই নাই’।
বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নাজনিন ফাতেমা বলেন, আমরা এখানে এসেছি যাতে এই মুক্তিযোদ্ধা কোটা উঠে যায়। আমরা চাই না কোটায় কেউ একটা যোগ্যতাসম্পন্ন জায়গায় যাক। এই জায়গায় যাওয়ার অধিকার শুধু মেধাবীদের।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়া ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মুশফিক মঈন বলেন, একটি স্বাধীন দেশে বৈষম্যের শিকার হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বৈষম্যের শিকারই যদি হবো, তাহলে যারা আজ বৈষম্য তৈরি করছে তাদের পিতারাই কেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন? ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলে মেধাবীদের রিকশা চালানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
ইবির ফটকমুখে মহাসড়ক অবরোধ
ইবি সংবাদদাতা জানান, কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও মহাসড়ক অবরোধ করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন তারা। পরে প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক ২০ মিনিট অবরোধ করেন। এ সময় চার দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
এ সময় আন্দোলনকারীরা বলেন, বৈষম্য দূর করার জন্য আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পরে কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে চরম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনো কোনো চাকরিতে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কোটা রেখে মেধাবীদের সাথে চরম অবিচার করা হচ্ছে। আমরা অতিদ্রুত কোটা সংস্কারের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করার দাবি জানাই। অন্যথায় সারা দেশের শিক্ষার্থীরা আরো কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল যোগাযোগ ব্যাহত
বাকৃবি প্রতিনিধি জানান, কোটা প্রথা সংস্কারের আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আন্দোলন চলমান রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি)। বিক্ষোভ মিছিল, রেলপথ অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচিতে কোটা প্রথা সংস্কারের আন্দোলন করছে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা। গতকাল আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে আব্দুল জব্বার মোড়ে অবস্থিত রেললাইনে চলমান ট্রেন অবরোধ করেন তারা। ফলে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যে রেল যোগাযোগ ব্যাহত হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর আবার স্বাভাবিক হয় রেল যোগাযোগ।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে মুক্তমঞ্চে এসে সমবেত হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাপদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় আপাতত বহাল আপিল বিভাগ বহাল রাখার বিষয়টি জানতে পেয়ে দুর্বার আন্দোলনে যোগ দেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা।
এক মুক্তিযোদ্ধার নাতি ও ভেটেরিনারি অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাসিব বলেন, ‘আমার দাদা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হওয়ার পরও আমি চাই যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল হোক। এই কোটার কারণে মেধাবীদের প্রতি অবিচার করা হোক দেশের বীরের নাতি হয়ে এটি আমি চাই না। কোটা থাকার কারণেই বরং নানা কটূক্তির শিকার হয়েছি। এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের রীতিমতো অবমাননা করা হয়।
কুবি সংবাদদাতা জানান, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে গতকাল প্রায় ৩ ঘণ্টা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষার্থীরা। পরে ৪ দফা দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন। তবে দাবি মানা না হলে রেললাইন অবরোধ করার কথা জানান তারা।
বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত মহাসড়কে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের ব্যানারে এ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় চার-পাঁচশ শিক্ষার্থী অবস্থান নেয়ায় মহাসড়কে ২০ কিলোমিটারের বেশি যানজটের সৃষ্টি হয়।
বিক্ষোভ কর্মসূচি ও সড়ক অবরোধের বিষয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আবু রায়হান বলেন, ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল তারা আজ সংসদে বসে আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ তারা ধ্বংস করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে সব কোটা ব্যবস্থা উঠিয়ে দেন। তবে তবে আজ কেন এই কোটা। সব সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা উঠিয়ে দিতে হবে।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু: মুশফিকুর রহমান বলেন, আপনারা চার দফা দাবি লিখিত আকারে আমাদের দিন। আমি বিকালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় বরাবর আপনাদের দাবিগুলো পৌঁছে দেব।


আরো সংবাদ



premium cement