০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জিলহজ ১৪৪৫
`

দ্বিতীয় দিনেও অচল সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান শিক্ষকদের
-


সর্বজনীন পেনশন প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে গতকাল দ্বিতীয় দিনেও শিক্ষক-কর্মচারীদের ধর্মঘটে অচল ছিল দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ দিকে এ বিষয়ে পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষকের।
ঢাবি প্রতিনিধি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের নেতৃত্বে প্রত্যয় স্কিম বাতিলে দেশের মোট ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস পরীক্ষা, দাফতরিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে সেমিনার, সান্ধ্যকালীন কোর্স, গবেষণা কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসালয়। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছে। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মূল ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকেরা। একই দাবিতে সকালে বিক্ষোভ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ। গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা- কর্মচারীরা একত্র হয়ে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন পথ প্রদক্ষিণ করে বিক্ষোভ মিছিল করে। পরবর্তীতে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে তারা।
গতকাল দুপুরে কলা ভবনের ফটকে অবস্থান কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা বলেন, ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রত্যয় স্কিমকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই আন্দোলন নিয়ে অনেক ধরনের বিভ্রান্তি-অপপ্রচার চলছে। বলা হচ্ছে এ আন্দোলন উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা। কিন্তু এটি উদ্দেশ্যমূলক নয়। আগামী প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য আমরা আন্দোলন করছি।

কর্মসূচিতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, দেশের মোট ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে একযোগে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষকেরা যোক্তিক দাবি আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম করছে। দাবির বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ফায়সালা চাই।
আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ক্ষতির বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, চলমান কর্মবিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পরে বিশেষ ক্লাস নিয়ে পুষিয়ে দেয়া হবে।
কর্মসূচিতে বিএনপিপন্থী সাদা দলের আহ্বায়ক আন্দোলনের সংহতি জানিয়ে বলেন, এ আন্দোলন আমাদের বাঁচা মরার আন্দোলন। এ আন্দোলন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমাদের দাবি পূরণে সরকার কালক্ষেপণ করলে, দেশের সাধারণ জনতা অংশ নেবে। আমাদের আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও আন্দোলনে কোনো ভিন্নতা নেই।

কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, শিক্ষক নেতা আমজাদ আলী, আবদুল বাছির, আবদুর রহিম, ফাজরিন হুদা, আবদুল মুহিত, মো: কামরুজ্জামান ও মনিরুল ইসলামসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকবৃন্দ।
অন্য দিকে প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে সকালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা কর্মচারী কল্যাণ সমিতির’ ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি আবদুল মোতালেব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়া কারো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রত্যয় স্কিম ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত শাসনে হস্তক্ষেপ করেছে। আমাদের ওপর প্রত্যয় স্কিম অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্য আজ দাফতরিক কাজকর্ম ছেড়ে রাজপথে আসতে বাধ্য হয়েছি।
তিনি আরো বলেন, অবিলম্বে প্রত্যয় স্কিম বাতিল ঘোষণা করে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে। দাবি মানা হলে আমরা নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাবো। নতুবা আমাদের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করবে।
জবি সংবাদদাতা জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
গতকাল মঙ্গলবার জবি শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে এ কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। এদিন দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান কর্মসূচিও পালন করেন তারা।

জবি শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড. মো: মমিন উদ্দীনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ড. শেখ মাশরিক হাসানের সঞ্চালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান, শিক্ষক সমিতির নেতারা বক্তব্য রাখেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়াও এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন অ্যাকডেমিক ভবনের সামনে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে এ অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় তারা সর্বজনীন পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন ও ইউজিসি কর্তৃক প্রণীত অভিন্ন নীতিমালা বাতিলের দাবি জানান।
এ সময় জবি কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের জারিকৃত সর্বজনীন পদ্ধতি অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু কিছুদিন আগে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রত্যয় নামে নতুন পদ্ধতি চালু করেছে। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীকে বাদ রেখে শুধু স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

তিনি আরো বলেন, যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই প্রত্যয় স্কিম মেনে চেলে, তাহলে আমরাও তা ভেবে দেখব। এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া হয়েছে আমাদেরকে। এই প্রত্যয় স্কিমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু লোকদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে একটা জাতিকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমরা এই প্রত্যয় স্কিমকে অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
ইবি সংবাদদাতা জানান, সর্বজনীন পেনশন প্রত্যাহারসহ তিন দফা দাবিতে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সর্বাত্মক আন্দোলনের ফলে অচল হয়ে পড়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। নিজেদের দাবি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তিন দফা দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষাসহ সকল কার্যক্রম বর্জন করে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অনুষদ ভবনের নিচতলায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। তিন দফা দাবিগুলো হলো, সর্বজনীন পেনশন প্রত্যাহারসহ, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। এ দিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম হতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রত্যাহারের এক দফা দাবিতে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা। একই দাবিতে কর্মবিরতি ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সহায়ক টেকনিক্যাল কর্মচারী সমিতি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান শিক্ষকদের : সর্বজনীন পেনশনের পঞ্চম স্কিম ‘প্রত্যয়’ নিয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা ‘প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার’ ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মূল ফটকে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচিতে ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার করে আগামী বছর ‘সেবক’ নামে স্কিম চালু হলে এবং সেখানে সবার জন্য সুযোগ-সুবিধা রাখা হলে আমরা সেখানে যাবো। দেশের স্বার্থে সবার জন্য যা হবে, আমাদের জন্যও তা হবে। তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু প্রত্যয় স্কিম বাতিল করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবি আবারো তুলে ধরেন তিনি।

দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার থেকে আন্দোলন চলার মধ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় এর শুভযাত্রা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের স্পষ্টীকরণ’ শীর্ষক বার্তা পাঠানো হয় জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ থেকে।
ওই বার্তায় বলা হয়, গত ৩০ জুনের আগে চাকরিতে যোগদানকারী শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নতুন স্কিমে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।
অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, তারা এতদিন কোথায় ছিলেন? আমরা এতদিন বিবৃতি-স্মারকলিপি দিয়েছি, সংবাদ সম্মেলন করেছি। সাড়ে তিন মাস আগে যদি আমরা জানতাম বয়সসীমা ঠিকই আছে, তাহলে শিক্ষকরা এত ক্ষুব্ধ হতো না। এখন আন্দোলন স্তিমিত করার জন্য একটা ব্যবস্থা করেছে।
তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের আমরা বিশ্বাস করি না। ২০১৫ সালে যেভাবে তারা আমাদের রাস্তায় নামিয়েছে। সুপার গ্রেড আমাদের দেয়নি। সে সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা কথা বলেছি, একটি কমিটিও হয়েছে। তবে ৯ বছরেও আমরা সুপার গ্রেড পাইনি।
তখনো আশ্বাস দিয়েছে। সুতরাং আশ্বাস দিলে হবে না। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে নিয়ে বসতে হবে। আমাদের সুপার গ্রেড দিতেই হবে। আপনারা আগামী বছর সেবক আনবেন, সেবকে কী সুযোগ সুবিধা আছে, সেটা আমরা দেখব। সর্বজনীন হলে আমরা কেন যাবো না? কিন্তু আমরা আলাদাভাবে যাবো না সেখানে।


আরো সংবাদ



premium cement