সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০২ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৬
সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তাও কর্মচারীরা ক্লাস পরীক্ষা, দাফতরিক কাজ বন্ধ করে দিয়ে কর্মবিরতি পালন করায় এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’ স্কিমকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এটি প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল সোমবার থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কর্মবিরতির ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ক্লাস-পরীক্ষা ও দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ধারাবাহিক আন্দোলনেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস না পেয়ে রোববার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মোর্চা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তাদের দাবি তিনটি হলো ‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন।
সর্বাত্মক কর্মবিরতির অংশ হিসেবে গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কর্মসূচি ঘোষণা করেন সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে গতকাল সোমবার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের সব ক্লাস বন্ধ থাকবে; অনলাইন-সান্ধ্যকালীন ক্লাস ও শুক্র-শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস বন্ধ থাকবে; সব পরীক্ষা বর্জন করা হবে; বিভাগীয় চেয়ারম্যান বিভাগীয় অফিস-সেমিনার-কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগার বন্ধ রাখবেন; একাডেমিক কমিটি-সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি ও প্রশ্নপত্র সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হবে না; অনুষদের ডিনরা তাদের কার্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন; নবীনবরণ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করা যাবে না; কোনো বাছাই বোর্ডের সভা হবে না; বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা ইনস্টিটিউটের কার্যালয়, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখবেন; সান্ধ্যকালীন, শুক্রবার ও শনিবারের ক্লাস বন্ধ থাকবে; বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালকরা কোনো সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপের কর্মসূচি নেয়া থেকে বিরত থাকবেন; বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ কর্যালয় বন্ধ থাকবে এবং প্রধান গ্রন্থাগারিক কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বন্ধ রাখবেন।
শিক্ষক সমিতির ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, গতকাল সকাল থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অনুষদ ও ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। রোববার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলো স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর। গতকাল সকালে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা হচ্ছে না।
জবি প্রতিনিধি জানান, সর্বজনীন পেনশনে ‘প্রত্যয়’ স্কিমকে ‘বৈষ্যম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সশরীরে এবং সান্ধ্যকালীন ক্লাস বন্ধ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মিডটার্ম, ফাইনাল, মৌখিক ও ভর্তি পরীক্ষাসহ কোনো ধরনের পরীক্ষাই নেয়া হচ্ছে না।
কর্মবিরতির প্রথম দিনে গতকাল সোমবার দুপুরে শিক্ষকরা ক্যাম্পাসের শহীদমিনার প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাশরিক হাসান বলেন, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলমান থাকবে। এ কর্মসূচির সাথে নতুন কোনো কর্মসূচি যুক্ত হবে কি না, তা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সিদ্ধান্ত নেবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন পেনশন কর্মসূচি ‘প্রত্যয়’ প্রত্যাহার করে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে গত রোববার পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেন। একই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন। বিকেলে শিক্ষক সমিতি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাতটি কর্মসূচির ঘোষণা করেন। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের/ইন্সটিউটের ক্লাসসমূহ বন্ধ রাখা। অনলাইন, সান্ধ্যকালীন, শুক্রবার ও শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস ও অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রাখা। মিডটার্ম, ফাইনাল, মৌখিক ও ভর্তি পরীক্ষাসহ কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। বিভাগীয় অফিস, সেমিনার, কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগার বন্ধ থাকবে। অ্যাকাডেমিক কমিটি, পরিকল্পনা কমিটি, প্রশ্নপত্র সমন্বয় ও অন্যান্য সভা অনুষ্ঠিত হবে না। ভর্তি পরীক্ষাসহ ডিন অফিসের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। কোনো সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হবে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষক প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। শিক্ষকদের এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে আন্দোলন ডাকার কারণে শিক্ষার্থীরা সেশনজটের আশঙ্কা করছেন। বাংলা বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রিদুয়ান ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থচিন্তার পাশাপাশি আমাদের কথাও ভাবা উচিত শিক্ষকদের। কোভিড মহামারীর কারণে ইতোমধ্যে আমরা প্রায় এক বছর পিছিয়ে গেছি। ২০২৩ সালে আমাদের অনার্স শেষ হওয়ার কথা ছিল, ২০২৪ এ এখন আমরা চতুর্থ বর্ষে।
‘এখন শেষ বর্ষে এসে যদি আবার আটকা পড়ি, তাহলে তো চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ব। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে, দেশের বাইরে যাবে অনেকে। আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে সবাই তো পিছিয়ে পড়বে প্রতিযোগিতামূলক জায়গাগুলো থেকে।’
অধিকাংশ বিভাগে সেমিস্টার ফাইনাল জুলাইয়ে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকদের এই আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা যথাসময়ে হওয়া নিয়ে শঙ্কিত গণিত বিভাগের চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থী চয়ন কৃষ্ণ দেব। এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাশরিক হাসান বলেছেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কিভাবে পুষিয়ে দেয়া যায়, তা নিয়ে ইতোমধ্যে তারা একটি মিটিং করেছেন।
‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের দাবি আদায় হয়ে গেলে অতিরিক্ত ক্লাস, অনলাইন ক্লাস নিয়ে ক্ষতিটা পূরণ করব।’ গত মার্চ মাসে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আগের চারটি স্কিমের সাথে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামের একটি প্যাকেজ চালু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন সব ধরনের স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই পরবর্তী সময়ে যোগ দেয়া কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা।
ইবি সংবাদদাতা জানান, সর্বজনীন পেনশন প্রত্যাহারসহ তিন দফা দাবিতে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সর্বাত্মক আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। গতকাল সোমবার ক্লাস-পরীক্ষাসহ সব কার্যক্রম বর্জন করে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত অনুষদ ভবনের নিচলতলায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা।
কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। এ সময় দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষকরা। এ ছাড়া জাতীয় স্বার্থে শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বড় ভূমিকা ছিল। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চলমান এ সঙ্কটে শিক্ষার্থীদেরও এগিয়ে আসা উচিত। শিক্ষক শিক্ষার্থীরা একসাথে থাকলে কোনো কুচক্রী মহল শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ষড়যন্ত্রের সাহস করবে না।
এদিকে সার্বজনীন পেনশন স্কিম হতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রত্যাহারের এক দফা দাবিতে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা